হায়দরাবাদ, 22 মে: অর্থনৈতিক বৈষম্য ভারতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা ৷ এই সমস্যা প্রায়ই রাজনৈতিক ময়দানে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে । রাজনৈতিক দলগুলি সম্পদের বণ্টনকে প্রভাবিত করে, এমন বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে সওয়াল করে এবং আলোচনাও হয় ৷ এই আলোচনাগুলি সাধারণত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিত করার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হয় ।
সম্পদ-বৈষম্য একটি দেশের সম্পদের বন্টনের পরিমাপ এবং আয়ের বৈষম্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত । তবে সম্পদের বৈষম্যের মধ্যে আয় এবং সঞ্চয়, বিনিয়োগ, শেয়ার এবং গয়নার মতো ব্যক্তিগত সম্পত্তির মূল্যও অন্তর্ভুক্ত । সম্পদের বৈষম্য জীবনযাত্রার মানের বৈষম্যের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ এবং এই বৈষম্য সমাজের সর্বস্তরের ভারসাম্য রক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ।
2024 সালের মার্চ মাসে 'ভারতে আয় এবং সম্পদের বৈষম্য' সম্পর্কিত ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সাম্প্রতিক গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ৷ এই রিপোর্ট ভারতের লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে রাজনৈতিক বিতর্কে মুখ্য ইস্যু ও বিরোধীদের এজেন্ডা হয়ে উঠেছে । ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে 1980-এর দশকের শুরু পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে । বিপরীতে জিডিপি বৃদ্ধির হার 1970 সালের গড় 2.9 শতাংশ থেকে 1980 এর দশকে যা বেড়ে 5.6 শতাংশ হয় । জিডিপি বৃদ্ধির কারণ মূলত শিল্পের উদারীকরণ, বাণিজ্যিক পরিকাঠামো ও নীতিগত সংস্কার, বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলি ।
ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও, এটি আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের উল্লেখযোগ্য কারণও । এটি বিশ্বাস করা হয় যে, বিশ্বায়ন দেশের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য হ্রাস করেছে ৷ কিন্তু দেশগুলির মধ্যে আভ্যন্তরীন সম্পদের বৈষম্য বাড়িয়েছে । উন্নত দেশগুলির তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে ।
তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে ৷ যেমন, রাশিয়া এবং আমেরিকার মতো কিছু উন্নত দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি । ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বাড়লে এটি সামাজিক বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে । অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস ও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে । তাই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ধরে রাখতে এই সংক্রান্ত বৈষম্যের মোকাবিলা করা ভারতের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
সম্পদের বৈষম্য:ব্যতিক্রমী ভাবে, রাশিয়ায় সম্পদের বৈষম্যের ব্যবধান বেশি ৷ রাশিয়ার সম্পদের 58.6 শতাংশ দেশের ধনী ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ৷ তারপরে এই তালিকায় রয়েছে ব্রাজিল ৷ সে দেশে জনসংখ্যার 1 শতাংশ ব্রাজিলের মোট সম্পদের 50 শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ৷ সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক বৈষম্যের দেশগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত ৷ আমাদের দেশের 40.6 শতাংশ সম্পদ ধনী ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ৷ তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছে আমেরিকা ৷ বাইডেনের দেশে 35.1 শতাংশ সম্পদ রয়েছে সেখানকার 1 শতাংশ ধনী ব্যক্তির কুক্ষিগত ।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে আয়ের স্তরের শীর্ষে থাকা ধনী ব্যক্তিদের 1 শতাংশের কাছে গড়ে 54 মিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদ রয়েছে, যা ভারতীয়দের গড় সম্পদের 40 গুণ । আয়ের ক্ষেত্রে নীচের স্তরে থাকা 50 শতাংশ এবং মধ্যবর্তী আয়ের স্তরে থাকা 40 শতাংশের কাছে যথাক্রমে 0.17 মিলিয়ন এবং 0.96 মিলিয়ন সম্পদ রয়েছে । সম্পদ বিতরণের একেবারে শীর্ষে 920 মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় 10000 ধনী ব্যক্তি গড়ে 22.6 বিলিয়ন সম্পদের মালিক, যা ভারতীয়দের গড় সম্পদের 16,763 গুণ ।
আয় বৈষম্য: ভারতের আয়ের বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি 10 শতাংশ হয়েছিল এবং 1951 সালে যা 37 শতাংশে পৌঁছেছিল ৷ পরে 1982 সালের মধ্যে সেটি 30 শতাংশে নেমে আসে ৷ 1990 এর দশকের শুরু থেকে পরবর্তী 30 বছরে 10 শতাংশের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেড়ে প্রায় 60 শতাংশ হয়েছে । আয়ের স্তরের এই বৈষম্যের একটি প্রাথমিক কারণ হল নিম্ন আয়ের নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষাগত ব্যবধান । আয়ের বণ্টন কতটা তির্যক, তা বোঝার জন্য ভারতে প্রতি দশজনের মধ্যে একজনই গড় আয় করতে পারে, এমন শর্তে আসতে হবে ।
কোভিড অতিমারী এবং আয় বৈষম্য: কোভিড অতিমারী আয়ের ক্ষেত্রে এই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ৷ কারণ, বাড়ি থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে শিক্ষার অত্যন্ত দরকার ছিল । যদিও প্রয়োজনীয় কর্মী এবং ঐক্যের ধারণার উপর অনেক জোর দেওয়া হয়েছে ৷ তবে, কঠোর বাস্তব এটাই, নিম্ন-দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকরা সম্ভবত চাকরি খুইয়েছেন এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীণ হয়েছেন । ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড তার রিপোর্টে তুলে ধরেছে, কম শিক্ষিত ব্যক্তিদের দায়িত্বের যে পরিবারগুলিতে অধিক সদস্য বা শিশু রয়েছে, সেগুলি কোভিড অতিমারী চলাকালীন আরও দরিদ্র হয়েছে এবং ওই পরিবারগুলির আয় উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে । এই ভাবেই কোভিড-19 অতিমারী দেশে দারিদ্র্য ও আয়-বৈষম্য বাড়িয়েছে ৷ যদিও তার প্রভাব ছিল অস্থায়ী ৷ দারিদ্র্য এবং আয় বৈষম্য 2021 সালের শেষ নাগাদ আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে ।
আয় বৈষম্যের মোকাবিলার উপায়: উচ্চতর বৃদ্ধির হার নিয়ে ভারত বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনীতির দেশ ৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সমস্যা হল সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য । ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মোকাবিলা করার জন্য সরকারের উচিত কর আরোপের আগের আয় এবং কর বাদ দেওয়ার পর পড়ে থাকা মূল আয়ের উপর মনোযোগ দেওয়া ৷ বিশেষ করে সরকারের উচিত দেশের মোট আয় এবং ব্যক্তির নিজস্ব আয়ের মধ্যে বৈষম্যের মোকাবিলায় মনোযোগ দেওয়া ।
জাতীয় নীতিগুলির লক্ষ্য ছিল, মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে নাগরিকদের মোট আয়ের মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনা ৷ এইভাবে সবার জন্য সমান স্তরের আয়ের ক্ষেত্র নিশ্চিত করা । কর এবং সামাজিক স্থানান্তরের মাধ্যমে সরকারি হস্তক্ষেপ ও সহায়তা দেশের নাগরিকদের বিভিন্ন প্রতিকূল ঘটনা যেমন বেকারত্ব, বার্ধক্য, পরিবারের সম্প্রসারণ, অক্ষমতা বা অসুস্থতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে ।
উচ্চ এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং আবাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য এখনও রয়ে গিয়েছে । এই বৈষম্যগুলির প্রভাব শিশুদের মধ্যেও পড়তে পারে ৷ ফলে, দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যেও বৈষম্যের সৃষ্টি করতে পারে । উপরোক্ত বিষয়গুলি মোকাবিলা করা গেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং বাসস্থানের উপর সরকারি আর্থিক সাহায্য দেশের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান কমিয়ে দেবে । অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে মৌলিক সামাজিক পরিকাঠামো, যেমন বিশুদ্ধ জল ও স্যানিটেশন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং শিক্ষার মতো সামাজিক বিনিয়োগে সবার সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে ।
দেশের ধনীদের উপর উপযুক্ত কর আরোপ: যদিও ভারতে ধনীদের উপর কর আরোপ করা নতুন কিছু নয় ৷ ভারতের আয়কর ব্যবস্থায় ধনীরা দরিদ্রদের তুলনায় বেশি আয়কর দেয় ৷ সরকার এই বেশি কর দেওয়াকে নিশ্চিত করার জন্য সারচার্জের বিধান এনেছে । বিশ্ব আয় বৈষম্য নিয়ে রিপোর্টে আরও জানাচ্ছে, ভারতের 167টি ধনী পরিবারের উপর মাত্র 2 শতাংশের 'সুপার ট্যাক্স' ধার্য করে চলতি আর্থিক বছরে রাজস্বের ক্ষেত্রে জাতীয় আয়ে 0.5 শতাংশ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যেতে পারে ৷ এই আর্থিক বৃদ্ধি সরকারকে দেশের সামাজিক খাতে উন্নয়নে বিনিয়োগে সহায়তা করবে ।
1940 এর দশকের শেষের দিকে ভারতে অত্যন্ত অসম আর্থ-সমাজিক পরিস্থিতি ছিল । তাই সমাজের আর্থিক বৈষম্য কমানোর জন্য 1953 সালে সম্পত্তি কর এবং 1957 সালে সম্পদ কর চালু করা হয়েছিল । তবে এই করগুলি যথাক্রমে 1985 এবং 2016 সালে প্রত্যাহার করে নেওযা হয় ।
সম্প্রতি, ভারতে উত্তরাধিকার কর পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং অর্থনীতিবিদ-সহ একাধিক মহলে বিতর্ক হয়েছে । তবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন যে, উত্তরাধিকার কর কার্যকর হলে গত 10 বছরে ভারতের অগ্রগতি 'শূন্য' হবে । অন্যদিকে 11 মার্চ 2024 সালে আমেরিকা তার বাজেট প্রস্তাবে ধনী আমেরিকানদের উপর কর আরোপের প্রস্তাব করেছিল । আমেরিকার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক উদ্যোক্তা স্যাম পিত্রোদা ভারতে উত্তরাধিকার কর চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা ভারতে বিতর্কের জন্ম দেয় ।
(উপরের মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত )
আরও পড়ুন:
- ভারতে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে, কারণ কি কোটিপতি রাজ ?
- অনুমানের চেয়েও বেশি, গত অর্থবর্ষে প্রায় 18 শতাংশ বাড়ল প্রত্যক্ষ কর আদায়
- ভারতে বাড়ছে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা, জেনে নিন মূলধন লাভের উপর কর বাঁচানোর কৌশল