মালদা, 11 মার্চ: প্রথম দফায় রাজ্যের 20টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিজেপি ৷ ঘোষিত প্রার্থীদের তালিকায় উত্তর মালদা লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে নাম রয়েছে বিদায়ী সাংসদ খগেন মুর্মুর ৷ 5 বছর ধরে তিনিই এই কেন্দ্রের সাংসদ ৷ তাই এই কেন্দ্রের ভোটাররা এখন এই সময়ের মধ্যে পাওয়া আর না-পাওয়ার হিসেব তৈরি করতে বসে পড়েছে ৷ পাঁচ বছরে সাংসদ মানুষের কথা কতটা সংসদে তুলে ধরেছেন ? সাংসদ তহবিলের টাকা তিনি কী কী উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করেছেন ? মানুষের চাহিদা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন ? সেই সব তথ্য জানার চেষ্টা করেছে ইটিভি ভারত ৷
সাংসদের দাবি অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে তাঁর সাংসদ তহবিলে মোটি 17 কোটি টাকা মঞ্জুর হয়েছে ৷ যেখানে করোনার জন্য 2020-21 অর্থবর্ষে সাংসদরা টাকা পাননি ৷ কিন্তু, তাঁর কাজের খতিয়ানে পাওয়ার থেকে না-পাওয়ার তালিকাটাই সবচেয়ে বেশি ৷ সাংসদ খগেন মুর্মুর কাজের মধ্যে রয়েছে:
চাঁচল ও মালদায় দু’টি উন্নত মানের অ্যাম্বুল্যান্স দেওয়া হয়েছে ৷
প্রতিটি এলাকায় সোলার ওয়াটার সোর্স দেওয়া ৷
একাধিক সোলার লাইট, মিনি হাইমাস্ট ল্যাম্প টাওয়ার করা হয়েছে ৷
রাস্তাঘাট-সহ আরও কিছু ছোটখাটো স্কিম কার্যকর ৷
সাংসদের দাবি, প্রকল্প অনুমোদন এতে একটু দেরি হয়েছে ৷ কারণ, এখন আগের মতো জেলাশাসকের মাধ্যমে স্কিম জমা দেওয়া যায় না ৷ পোর্টালে আপলোড করতে হয় ৷ দিল্লি থেকে সেই স্কিম অনুমোদিত হয়ে আসে ৷ তারপরেও আরও কিছু প্রক্রিয়া থাকে ৷ তবে, সাংসদ কোটার টাকায় কাজ করার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন খগেন মুর্মু ৷ আর সেই কারণে, বেশ কিছু স্কিম ঝুলে রয়েছে ৷
তবে, না পাওয়ার তালিকাটা সবচেয়ে বড় ৷ মূলত, কেন্দ্রে অধীনে থাকা বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যার সমাধান খগেন মুর্মু করতে পারেননি বলে অভিযোগ ৷ সেগুলি হল-
গঙ্গার ভাঙনের সমস্যায় কোনও সমাধান 5 বছরে করতে পারেননি সাংসদ ৷
মালদা উত্তর লোকসভা থেকে প্রচুর লোকজন বাইরের রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন ৷ তার সমাধান করতে পারেননি খগেন মুর্মু ৷
গাজোলের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধায় পীরগঞ্জ ঘাটে সেতুর দাবি মেটাতে পারেননি ৷
মালদার আম শিল্পের উন্নতিতে কোনও উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ ৷
জেলায় শিল্পতালুক ও কলকারখানা তৈরির দাবিও মেটাতে ব্যর্থ মালদা উত্তরের সাংসদ ৷
মালদার পাট চাষ ও পাট শিল্পের উন্নতিতেও কোনও ব্যবস্থা করতে পারেননি ৷
উত্তর মালদা লোকসভা কেন্দ্রের ভাঙন প্রবণ রতুয়া এলাকার বাসিন্দা সহিদুর রহমানকে এনিয়ে ধরা হলে তিনি বলেন, "খগেন মুর্মু গত পাঁচ বছর আমাদের সাংসদ ছিলেন ৷ কিন্তু, আমাদের এলাকায় তাঁর কোনও কাজ দেখতে পাচ্ছি না ৷ আমাদের মূল সমস্যা গঙ্গা ভাঙন ৷ এখন এটা জাতীয় সমস্যা ৷ ভাঙন নিয়ে সংসদে তিনি কোনও দিন কথা বলেছেন কি না, তা জানি না ৷ তবে, গত বন্যার সময় টিভিতে একবার তাঁর ছবি দেখেছি ৷ আমাদের অন্যতম অর্থকরি ফসল পাট ৷ কিন্তু, আমরা পাটের দাম পাই না ৷ সঠিক দাম না-পেয়ে অনেক পাটচাষি আত্মহত্যা করেছে ৷ ধানের মতো সরকারি সহায়ক মূল্যে পাট কেনা হলে আমরা একটু বাঁচতাম ৷ আমের জন্যও তিনি কিছু করেননি ৷ অথচ এসব নিয়ে তিনি সংসদে আবেদন করতে পারতেন ৷ এখানে শিল্প গড়তেও তাঁকে উদ্যোগী হতে হত ৷"
পুরাতন মালদার নরহাট্টা পঞ্চায়েতের বুধিয়া গ্রামের বাসিন্দা সফিকুল আলম বলছেন, "কিছু পাওয়া তো দূরের কথা, আমরা এখনও পর্যন্ত সাংসদকে দেখতেই পাইনি ৷ দেখতে পেলে তো তাঁর কাছে আবেদন করব! এখানে সাংসদ কোটার টাকায় কোনও কাজই হয়নি ৷ সারা দেশে জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম ৷ এখানকার শ্রমিকরা বাইরে কাজে গিয়ে মারা যাচ্ছে ৷ মালদা আম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ৷ সাংসদ তো এখানে আম নিয়েই কোনও শিল্প স্থাপনে উদ্যোগ নিতে পারতেন ৷ তাহলে অনেক ছেলেমেয়ে সেখানে কাজ পেত ৷ গঙ্গা ভাঙন গোটা জেলারই মূল সমস্যা ৷ একসময় মালদা শহরও গঙ্গায় তলিয়ে যাবে ৷ উত্তর মালদার পীরগঞ্জ ঘাটে একটি সেতু হলে গাজোলের সঙ্গে যোগাযোগে সুবিধে হত ৷ সাংসদ সেই ব্রিজ নির্মাণে উদ্যোগ নিতে পারতেন ৷ সিপিআইএমে থাকাকালীন তিনি বিধায়ক ছিলেন, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষও ছিলেন ৷ তখন মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ভালো ছিল ৷ বিজেপি সাংসদ হওয়ার পর তাঁর আগের মূল্যবোধ আর কিছু নেই ৷ শুধু ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়েই পার পেতে চাইছেন ৷"
এক ভোটার কাঞ্চন ভাইপাল অবশ্য সাংসদের কাজে কিছুটা হলেও সন্তুষ্ট ৷ তিনি বলেন, "খগেনবাবু কিছু কাজ করেছেন ঠিক, কিন্তু যতটা তাঁর কাছে আশা করেছিলাম, তিনি তা পূরণ করতে পারেননি ৷ আমরা ভেবেছিলাম, কেন্দ্রীয় সরকারি দলের সাংসদ হিসাবে তিনি গঙ্গা ভাঙন, বেকার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবেন ৷ শিল্প স্থাপনে উদ্যোগ নেননি ৷ হয়তো করোনার জন্য তিনি আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারেননি ৷ আমাদের সবচেয়ে বড় চাহিদা এই জেলায় শিল্প স্থাপন করা ৷ তবে সাংসদ আমাদের কথা সংসদে তুলে ধরেন ৷"
পুরাতন মালদার মিন্টু দত্ত বলছেন, "সাংসদ এই পাঁচ বছরে কাজের কাজ তেমন কিছু করেননি ৷ মালদার মূল সমস্যা নদী ভাঙন ৷ এটা অনেক পুরোনো সমস্যা ৷ কিন্তু ভাঙন রোধে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা তিনি পূরণ করতে পারেননি ৷ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কিছু করার কথা বলেছিলেন সাংসদ৷ ৷ কিন্তু, আমরা তাঁকে সেই উদ্যোগ নিতে দেখিনি ৷ মন্দির আলাদা জিনিস ৷ এসব মানুষের জীবনের মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে না ৷ এসব উন্নয়ন বলে আমি মনে করি না ৷ মানুষের জীবনের মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে আমরা সাংসদকে তেমন কিছু করতে দেখিনি ৷"
তৃণমূলের মালদা জেলার সহ-সভাপতি দুলাল সরকার বলছেন, "উত্তর মালদার সাংসদ আগে সিপিআইএম করতেন ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর নামাবলি পালটে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন ৷ উত্তর মালদার মানুষ বরকতদার পর তাঁকে নির্বাচিত করেছিলেন ৷ সাড়ে চার বছরে তিনি কোনও কাজই করেননি ৷ তিনি সংসদে গিয়েছেন কিনা তাও জানি না ৷ তিনি বলতেন, চাইলেই তিনি নাকি 100 দিনের কাজের টাকা পাইয়ে দেবেন ৷ অন্যান্য প্রকল্পের টাকাও নিয়ে আসতে পারবেন ৷ কিছুই করেননি ৷ এরা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখে, জনগণের নয় ৷ ফলে এই সাংসদের রিপোর্ট কার্ড শূন্য ছাড়া কিছু হতে পারে না ৷ শুধু দিল্লি ঘোরার জন্য সাংসদ হয়েছেন তিনি ৷ উত্তর মালদায় প্রচুর সমস্যা ৷ একটি সমস্যারও সমাধান করতে পারেননি ৷ নদী ভাঙন এলাকায় কেন্দ্রের কোনও প্রতিনিধি দলকেও আনতে পারেননি ৷ একশো দিনের টাকা না পেয়ে আত্মঘাতী শ্রমিকদের পরিবারের পাশে তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়নি ৷"
আরও পড়ুন: