নয়াদিল্লি, 9 ফেব্রুয়ারি: পাকিস্তানের নয়া সরকার কি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হবে ? বৃহস্পতিবারের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল যতটা আগ্রহী, ঠিক ততটাই আগ্রহী এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ৷ অনেক সময় সরকারে পরিবর্তন হলে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হয় ৷ যদিও পাকিস্তানের এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে নতুন সরকারের পক্ষে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এখনই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটার বিষয়টি সম্ভব নয় ৷
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে দ্বাদশ জাতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৷ 241 মিলিয়ন জনসংখ্যার এই পারমানবিক শক্তিধর দেশে এখন ভোট গণনা চলছে ৷ সে দেশের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) প্রধান দল হিসেবে উঠে আসতে পারে ৷ দ্বিতীয় স্থানে থাকতে পারে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৷ তবে ভালো লড়াই দেবে পাকিস্তানের আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ৷
যদি পিএমএল-এন সরকার গড়ে, আর প্রধানমন্ত্রী পদে আবার বসার সুযোগ পান নওয়াজ শরিফ, তাহলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের জট আবার কাটার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন ৷ বিশেষ করে পিএমএল-এন এর ইস্তাহারও সেই দিকে ইঙ্গিত করছে ৷ কারণ, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গিতে নজর দেওয়া হবে ৷ আঞ্চলিক উত্তেজনা মোকাবিলা ও প্রশমনের জন্য উভয় দেশকে দীর্ঘমেয়াদী কূটনৈতিক আলোচনায় জড়িত থাকতে হবে । জম্মু ও কাশ্মীর-সহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে প্রাধান্য দেওয়া হবে ৷’’
এছাড়াও নওয়াজ শরিফের দলের ইস্তাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘‘পাকিস্তান একটি ভারসাম্যপূর্ণ অংশীদারিত্বের জন্য চেষ্টা করবে ৷ উভয় পক্ষের জন্য ন্যায়সঙ্গত সুযোগ নিশ্চিত করবে ৷ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য এবং সার্ক (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন) অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্য নতুন পথ খুলে দিতে পারে । ভারতের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইসলামাবাদে বহু বিলম্বিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করা হবে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতা নীতিকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হবে ।’’
সার্ক হল একটি আঞ্চলিক আন্তঃসরকারি সংস্থা এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলির ভূ-রাজনৈতিক ইউনিয়ন । এর সদস্য দেশগুলো হল - আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা । 2021 সালের হিসেবে সার্ক বিশ্বের ভূমি এলাকার 3 শতাংশ, বিশ্বের জনসংখ্যার 21 শতাংশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির 5.21 শতাংশ নিয়ে গঠিত ।
2016 সালের সেপ্টেম্বরে জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে একটি সেনা ঘাঁটিতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিরা হামলা চালায় ৷ সেই বছর পাকিস্তানে সার্ক সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ৷ কিন্তু হামলার জেরে ভারত ওই সম্মেলন বয়কট করে ৷ তার পর অন্য দেশগুলিও ভারতের সঙ্গে সহমত পোষণ করে ৷ ফলে সম্মেলন বাতিল হয়ে যায় ৷ তার পর থেকে আর এই সম্মেলন হয়নি ৷
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয় পুলওয়ামায় হামলা হওয়ার পর ৷ নয়াদিল্লির বক্তব্য, সন্ত্রাসে মদত ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না ৷ সেই কারণেই দুই প্রতিবেশী দেশের ‘মুখ দেখাদেখি বন্ধ’ ৷ ইসলামাবাদে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে কি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আবার ঠিক হতে পারে ? পিএমএল-এন এর ইস্তাহারের কথা উল্লেখ করে জং গ্রুপের সংবাদপত্রের সিনিয়র সাংবাদিক খালিদ মাহমুদ খালিদ জানান যে নওয়াজ শরিফ অবশ্যই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চান ।
বৃহস্পতিবার লাহোরে ভোট দিয়ে এসে ফোনে ইটিভি ভারতকে খালিদ বলেন, ‘‘যাইহোক, যতক্ষণ নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন ও ভারতের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বের না হওয়া পর্যন্ত এটা বলা কঠিন ৷’’ খালিদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন এহসান আহমেদ সেহার ৷ তিনি দৈনিক সংবাদপত্র নওয়া-ই-আহমেদপুর শরকিয়া পাকিস্তানের প্রধান সম্পাদক এবং অল পাকিস্তান রিজিওনাল নিউজপেপার সোসাইটির পৃষ্ঠপোষক ৷
তিনি পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়ালপুরের বাসিন্দা ৷ বৃহস্পতিবার সেখানে নিজের ভোট দেন ৷ তার পর ফোনে ইটিভি ভারতকে জানান, পিএমএল-এন ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সমর্থক ৷ কিন্তু তাঁরা সরকারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসে কি না, সেটাই দেখার ৷ যদি নওয়াজ শরিফের দল দুই তৃতীয়াংশ আসনে না জেতে, তাহলে কে প্রধানমন্ত্রী হবে, তা নিয়ে আলোচনা হবে ৷
তবে ইমরান খানের দল পিটিআই-কেও সরকারে আসার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করা হয় ৷ তবে নেতা ইমরান জেলে আর এবার তাদের প্রতীক ব্যাট দেওয়া হয়নি ৷ তাই তাদের লড়াই বেশ কঠিন বলেই মনে করেন পাকিস্তানের এই দুই সাংবাদিক ৷ কিন্তু পিটিআই যদি ক্ষমতায় চলে আসে ৷ তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের সেভাবে উন্নতি হবে না ৷ কারণ, ইমরান খান নওয়াজ শরিফের থেকে ভিন্ন অবস্থানে থাকেন ৷ ইমরান চান ভারতের সঙ্গে আলোচনার আগে জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হোক ৷
এবার নওয়াজ শরিফের দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে কী হবে ? পিপিপি আবার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় উঠে আসবে ৷ কারণ, ইমরানের সরকারের পতনের পর নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফের সরকারে পিপিপিও সমর্থন দিয়েছিল ৷ সেহারের মতে এবারও যদি তা হয়, তাহলে পিপিপি বড় দু’টো দাবি আদায় করার চেষ্টা করবে ৷ প্রথমত, তারা আসিফ আলি জারদারিকে (বিলওয়াল ভুট্টোর বাবা ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর স্বামী) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বানাতে চাইবে ৷ দ্বিতীয়ত, তারা পঞ্জাব প্রদেশের গর্ভনরশিপ চাইবে ৷
2007 সালে বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয় ৷ তার পর থেকে নওয়াজের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আসিফ আলি জারদারির ৷ অন্যদিকে পঞ্জাব প্রদেশে নওয়াজের দলের জনসমর্থন একসময় পিটিআই-তে চলে গিয়েছিল ৷ সেই ভোট এবার ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা করেছে পিপিপি ৷
ফলে পাকিস্তানে কার সরকার হয় সেটাই এখন দেখার ৷ তার পরও ভারতে লোকসভা নির্বাচনের আগে নয়াদিল্লিও পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ফেরানোর চেষ্টা করবে বলে মনে হয় না, এমনটাই মনে করেন খালিদ ৷ তাছাড়া পাকিস্তানে সরকার যারই হোক, শেষ সিদ্ধান্ত নেবে সেনাই ৷ তবে খালিদ বলেন, “সেনাবাহিনী সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করলেও, নির্বাচনের পর বিশ্ব দেখবে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে ।”
আরও পড়ুন: