ভারতের প্রাচীন চিকিৎশাস্ত্র তথা আয়ুর্বেদ বর্তমানে আবার নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । এখনকার মানুষ যে কোনও চিকিৎসার রাসায়নিক উপাদানে প্রস্তুত ওষুধের বদলে প্রাকৃতিক গাছগাছড়ার প্রয়োগে বেশি আগ্রহী । তাই আমরা আজ জানাচ্ছি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত, বিখ্যাত ঔষধি ‘টিনোস্পোরা কর্ডিফলিয়া’ সম্পর্কে, যা জনপ্রিয় গুরুচি তথা গিলয় নামে । আমাদের আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞ, ডা. রাজ্যলক্ষ্মী মাধবম, MD আয়ুর্বেদ, AMD আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ, হায়দরাবাদ, বলেন, “গুরুচি, গিলয় বা অমৃত, এই সব কিছুই হল একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গাছ-গাছড়ালব্ধ ঔষধির নাম ৷ যার উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্রে । অমৃত নামটি নেওয়া হয়েছে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র থেকে, যেখানে অমৃত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে , এটি মৃত মানুষের জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ঈশ্বরকে অসুস্থতা ও বার্ধক্য থেকে দূরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হত । একে ‘‘নেক্টর অফ ইমর্টালিটি’ তথা ‘অমরত্ব লাভের অমৃতসুধা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে ।”
গুরুচির একাধিক উপকারিতা রয়েছে এবং আয়ুর্বেদে একে একাধির রোগের নিরাময়ের উপায় হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে । এর মধ্যে কয়েকটি আমাদের জানাচ্ছেন ডা. রাজ্যলক্ষ্মী ।
1. অ্যান্টি—ডায়াবেটিক : আজকের দিনে খুবই সাধারণ একটি রোগ, ডায়াবিটিস নিরাময়ে গিলয় উপকারী । রক্তে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে আনতে এটি সাহায্য করে ।
2. অ্যান্টিপাইরেটিক : গিলয় রক্তের তাপমাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে ।
3. অ্যান্টিস্প্যাজমোডিক : শরীরে স্প্যাজমোডিক ব্যথা লাঘব করতে এটি সাহায্য করে ।
4. অ্যান্টি—ইনফ্ল্যামেটরি : এটি টিশুর প্রদাহ লাঘব করে ।
5. অ্যান্টি আর্থারাইটিক : রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস নিরাময়ে গিলয় উপকারী। তাছাড়া এটি গৌটি আর্থারাইটিসে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমিয়ে আনতেও সাহায্য করে ।
6. গিলয় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এবং ইমিউনোমডুলেটার হিসাবেও কাজ করে।
7. গিলয় মানসিক চাপ, উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে, বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধে্য যা হামেশাই দেখা যায়।
8. গিলয়ের ম্যালেরিয়া-নাশক গুণাগুণও রয়েছে। বর্ষার সময় এই রোগের প্রাদুর্ভাব নতুন ঘটনা নয়।
9. অ্যান্টি-অ্যালার্জিক হিসাবেও গিলয় কাজ করে। ধূলোবালি, সূর্যালোক এমনকী কিছু কিছু খাবার থেকেও অনেকের অ্যালার্জি হয়। গিলয় তা নিরাময়ে সাহায্য করে।
10. কিছু কিছু চামড়ার রোগ যেমন একজিমা, কুষ্ঠ নিরাময়েও গিলয় ব্যবহার করা হয়।
11. গিলয় হেপাটোপ্রোটেকটিভ । অর্থাৎ এর লিভারের ক্ষতি রুখে দেওয়ার ক্ষমতা আছে । এটি লিভারকে টক্সিন থেকে বাঁচায় ।
12. গিলয়ের ক্যানসার—রোধক গুণাগুণও রয়েছে । এটি নিওপ্ল্যাজমের বিরুদ্ধে লড়াই করে তথা শরীরের কিছু কিছু অঙ্গে ক্যানসার—আক্রান্ত টিসু্যর নতুন করে বৃদ্ধি আটকে দেয় ।
গুরুচি ট্যাবলেট, পাউডার, কাশ্যপ ট্যাবলেট বা গুরুচি খাওয়া যেতে পারে, তবে তা কেবলমাত্র কোনও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পরই । চিকিৎসক যেমন বলবেন, তেমনভাবেই জল বা মধুর সঙ্গে এটি সেবন করা যেতে পারে ।
ডা. রাজ্যলক্ষ্মী বলেছেন, “গুরুচি নিয়ে এত গবেষণা হয়েছে এবং এটি নানা ধরনের রোগব্যধি নিরাময়ে এর বহুমুখী পারদর্শিতা দেখিয়েছে । ঋদ্বেদ এবং অথর্ববেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিমগাছে যে গুরুচিলতা বেড়ে ওঠে, তার ক্ষমতা এবং এটি অধিক পরিমাণে ইমিউনোমডুলেটরি কার্যকলাপ করতে সক্ষম । তিনি আরও জানাচ্ছেন, আয়ূষ মন্ত্রক এবং CSIR—এর (কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ) যৌথ উদে্যাগে নভেল কোরোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গুরুচি এবং অন্যান্য আয়ুর্বেদিক গাছগাছড়ার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতিমধে্যই শুরু হয়ে গেছে । তিনি বলেছেন, যেহেতু এতে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস রয়েছে, তাই গুরুচি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়ে। যেহেতু এর অ্যান্টি—পাইরেটিক গুণাগুণ রয়েছে এবং এটি শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাও মেটাতে সক্ষম, তাই COVID-১৯ এর কিছু কিছু উপসর্গের বিরুদ্ধে লড়তে এটি সহায়ক হতে পারে । তাঁর কথায়, “সম্প্রতি এর ঔষধি গুণাগুণের কথা বিবেচনা করে ভারত সরকার গুরুচিকে সম্মান জানিয়েছে এবং একে রাষ্ট্রীয় ঔষধি (ন্যাশনাল হার্ব) হিসাবে ঘোষণা করেছে । সুতরাং, উপকারিতায় ভরপুর, গিলয় হল এমন একটি হার্ব, যার ব্যবহার আমাদের দেশে সেই প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে এবং আমরা আশা করতে পারি যে, অন্যান্য কিছু হার্বের পাশাপাশি এই গুরুচিও নভেল কোরোনার বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ে ত্রাতা হিসাবে প্রতিপন্ন হবে ।