কলকাতা : সেই 'সোনার হরিণ' ধারাবাহিকের হাত ধরে মেগা সিরিয়ালের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় । এখন তিনি বাংলা টেলি সিরিয়াল জগতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম । লীনার সিরিয়াল মানেই একান্নবর্তী পরিবার, শহুরে শিক্ষিত বাঙালি মানসিকতা, কোথাও আবার গ্রাম্য মেঠো সুর, মূল্যবোধের শক্ত বুনোট, ভালো-মন্দের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মর্মস্পর্শী সংলাপ । লীনার লেখনীতে বেরিয়ে আসে এসব কিছুই ।
'ইষ্টিকুটুম, 'জল নুপুর', 'চোখের তারা তুই', 'পুণ্যিপুকুর', 'ইচ্ছেনদী', 'ফাগুন বউ', 'নকশি কাঁথা', 'কুসুম দোলা'র মত একাধিক ধারাবাহিকে লেখক হিসেবে, গল্পকার হিসেবে, চিত্রনাট্যকার হিসেবে, সংলাপ নির্মাতা হিসেবে কাজ করেছেন লীনা । প্রত্যেকটি ধারাবাহিক জনপ্রিয় হয়েছে । সম্প্রতি সম্প্রচারিত হওয়া 'শ্রীময়ী', 'মোহর', 'কোড়া পাখি', 'খরকুটো'র মধ্যেও ফুটে ওঠে সেই চেনা লীনাই । তাঁর কাহিনি বিন্যাস নিয়ে দর্শকেরও বিস্তর আলোচনা হয় । জীবন থেকে উঠে আসা চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন তাঁরা । এই মুহূর্তে লীনার কলম থেকে বেরিয়ে আসা শ্রীময়ী, মোহর, আমনদের সঙ্গে কী ভীষণ মিল বাস্তবে দেখা চরিত্রগুলোর । কিন্তু কে লীনা ? কীভাবে ধারাবাহিক নির্মাণের সম্রাজ্ঞীর আসন গ্রহণ করলেন তিনি ? খোঁজ নিল ETV ভারত সিতারা ।
শুনলে অবাক হবেন, ধারাবাহিকের অন্যতম সৃষ্টিকর্তা লীনা একসময় মেগা সিরিয়াল দেখতেনই না । টিভিতে কোনও সিরিয়াল চললে, চ্যানেল ঘুরিয়ে দিতেন । খবরের চ্যানেলই ছিল তাঁর প্রিয় । বাড়ির লোকজন রাগারাগিও করতেন লীনার উপর । লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন বরাবর । প্রথম জীবনে কলেজে পড়াতেন । বাংলার অধ্যাপিকা ছিলেন । তবে লেখালেখির মতো শৈল্পিক বিষয়ে তো আর হুট করে পারদর্শী হওয়া যায় না । তাই প্রথম থেকেই খাতা-কলমের সঙ্গে ছিল লীনার নিবিড় সম্পর্ক । একেবারে অন্য ধরনের লেখালেখি করতেন সেই সময় । ছোটোবেলার স্কুল ম্যাগাজ়িনে লিখতেন । 2-3 টে স্কুলে পড়েছেন । যেমন কমলা গার্লস, সিস্টার নিবেদিতা । কলেজ ছিল রামকৃষ্ণ মিশন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন । মেয়েবেলায় গল্প দাদুর আসরে গল্প পড়তেন নিয়মিত । 5-6 বছর বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চা করতেন তিনি । সম্পূর্ণ অন্য জীবনযাত্রা ছিল তাঁর । বাংলা বিনোদনজগতের অনেক দূরের বাসিন্দা ছিলেন এখনকার বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ।
একথা সকলেই জানেন যে, ভাগ্য খুবই অপ্রত্যাশিত । সে কার জন্য কী লিখে রেখেছে, তা আগে থেকে হলফ করে বলা খুব মুশকিল । না হলে অধ্যাপনা ছেড়ে একদিন পুরোদস্তুর ধারাবাহিকের লেখিকা হয়ে উঠবেন, লীনা কি জানতেন ? উত্তর হল "না" । বেশ চলছিল অধ্যাপনা, কলেজে গিয়ে ক্লাস নেওয়া । মাঝে হঠাৎই ফরমায়েশ এল ট্রোন প্রযোজনা সংস্থা থেকে । তাঁকে ধারাবাহিকের জন্য লিখতে হবে । সেই ধারাবাহিকের নাম 'সোনার হরিণ' । এক মাসের লেখালেখির কাজ করে দিতেই হবে, তেমনই ছিল আবদার । যে মানুষ কোনওদিন ধারাবাহিক দেখেননি, তাঁকে এই ধরনের অনুরোধ করা অদৃষ্টের চক্রান্ত ছাড়া আর কী ? চিরজীবন চ্যালেঞ্জকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন, তাই অনুরোধকে ফেলতে পারলেন না । ভাগ্যিস ফেলেননি । নাহলে, অধরাই থেকে যেত বাহা, পরমেশ্বরী, কঙ্কাবতীরা ।
ETV বাংলাতে সম্প্রচারিত 'সোনার হরিণ'-এর 450 এপিসোড থেকে শুরু করেছিলেন লেখালিখি । এত সফল হয়েছিলেন, যে 1800 এপিসোড পর্যন্ত লিখে যেতে হয়েছিল লীনাকে । সেইসঙ্গে লিখতেন 'চেনা-অচেনা' ধারাবাহিকের জন্যেও । সেটি ছিল ধারাবাহিকে পাওলি দামের শেষ কাজ । দূরদর্শনের 'সীমানা ছাড়িয়ে' ধারাবাহিকেও লিখেছিলেন সেই সময় । এভাবেই বাংলা ধারাবাহিকে আটকে গেলেন লীনা । ধীরে ধীরে তৈরি করলেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ম্যাজিক মোমেন্টস । শুরু হল স্বাধীনভাবে পথ চলা । প্রথম ধারাবাহিক 'বিন্নি ধানের খই' । পরপর 'কেয়া পাতার নৌকো', 'ইষ্টিকুটুম'এর মতো ধারাবাহিক চলতে থাকে ।
লীনা যখন ধারাবাহিক তৈরি করছেন, সমান্তরালভাবে তৈরি হচ্ছে অন্যান্য মেগাও । একাধিক চ্যানেল, একাধিক প্রযোজক উঠে আসছে । আসছেন নতুন লেখকরাও । প্রতিদ্বন্দ্বীতার সম্মুখীন হতে হয়েছে অনেকবার । তবে সেসব নিয়ে কোনও কালেই মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি লীনাকে । নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে এসেছেন চিরকাল । উপলব্ধি করেছেন যে, নিজেকেই নিজের কাছে জিততে হয়, হারতে হয় । নিজেই নিজের পরীক্ষা নেন প্রতিদিন । এই আত্মবিশ্বাসকেই জীবনের পাথেয় করে এগিয়ে চলেছেন লীনা ।
একসঙ্গে একাধিক ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেন লীনা । এত চরিত্র, এত সংলাপ, ঘটনাবলী...সাজাতে হয় দিনরাত । আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো লীনার কাছেও ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে, একঘেঁয়ে হয়ে ওঠে বিষয়টা । কিন্তু সেই নেগেটিভিটিকে এক তুড়িতে ঘায়েল করেছেন লীনা । আসলে অর্থ একটা বড় বিষয় । মনকে শক্ত করে প্রশ্ন করেছেন, যে অর্থ উপার্জন করছেন এই কাজ করে, অন্য কোথাও কি পেতেন ? আজকের লীনা যা হতে পেরেছেন, এই কাজের জন্যই পেরেছেন । শুধু তাই নয় তাঁর কাজের দিকে তাকিয়ে থাকেন বহু আর্টিস্ট ও টেকনিশিয়ান । ক্লান্তি এলেই এই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে সাজিয়ে নেন, মনের জোর বাড়িয়ে তোলেন ।
বরাবরই বাস্তবজীবনে দেখা মানুষদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছে লীনার চরিত্ররা । তাঁর গল্পবিন্যাস কিংবা চরিত্রগঠনের ক্ষেত্রে কখনওই চ্যানেল হস্তক্ষেপ করেনি । হস্তক্ষেপ করলেও হয়তো তিনি শুনতেন না । এখন মোটামুটি সমস্ত চ্যানেলই জেনে গেছে, লীনা গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে জোর করে কোনও কাজ হয় না । তিনিই ঠিক করেন কীভাবে চলবে গল্প । তবে দর্শককেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারকের আসনে বসিয়েছেন লীনা । দর্শকের জন্যেই তো এই সবকিছু...