কলকাতা, 2 ফেব্রুয়ারি: আত্মবিশ্বাস এমন এক সংক্রমণ যা যে কোনও পরিস্থিতিতে ব্যক্তি বিশেষের শরীরীভাষা বদলে দেয় । সুপার কাপ ট্রফি জয় সেই সংক্রমণই ঘটিয়েছে লাল হলুদ শিবিরে । গোমড়া মুখ নেই । ছক নিয়ে লুকোছাপা নেই । অনেকটা খোলা বইয়ের পাতা কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাতের অনুশীলন । ম্যাচের 24 ঘণ্টা আগে অনুশীলন পর্দার আড়ালে রাখলেন । তার আগে পুরো প্র্যাকটিস দেখার জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে পরপর কয়েকটি ম্যাচ হেরে বেশ খানিকটা চাপে বাগান শিবির। এক হিসেবে বলাই যায় প্রায় বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে শনিবারের কলকাতা ডার্বিতে মুখোমুখি হবে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান।
শুক্রবার দলের অধিনায়ক ক্লেটন সিলভাকে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এসেছিলেন কুয়াদ্রাত। সুপার কাপ জয়ের পরে প্রত্যাশার পারদ চড়ছে দেখেও তিনি তাতে ভেসে যেতে নারাজ । বরং বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আইএসএলের জন্য ছক সাজাতে চাইছেন । হারের হ্যাটট্রিক থেকে আইএসএলে টানা পাঁচ ম্যাচ অপরাজিত । আইএসএলের দশ ম্যাচে জয়ের সংখ্যা মাত্র দুই । ড্র পাঁচটি ম্যাচে । যা তাঁকে এগারো পয়েন্ট নিয়ে আট নম্বরে দাঁড় করিয়েছে । বাকি ম্যাচের সাফল্য পয়েন্ট টেবিলের ছয় নম্বরে তুলে নিয়ে যেতে পারে । অঙ্কটা জানেন বলেই কুয়াদ্রাত হিসেব কষে আইএসএলের কৌশল সাজাতে চাইছেন । ভারতে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর নতুন নয় । কিন্তু কলকাতায় কাজ করতে এসে ডার্বির গুরুত্ব দ্রুত উপলব্ধি করেছেন । ফলে আপাতত তিনটে ডার্বিতে প্রতিপক্ষ মোহনবাগান সুপারজায়ান্টকে দু'বার টেক্কা দিতে পেরেছেন । আর তাতেই প্রত্যাশার পারদ চড়েছে ।
কুয়াদ্রাত বলছেন, তাঁর দলের ছেলেরা ফোকাসড । মোটিভেশনের অভাব নেই । প্রথম ডার্বিতে নামার আগে মাত্র কয়েকদিনের অনুশীলন করিয়েছিলেন । তারপর ধীরে ধীরে দলকে গড়ে তুলেছেন । বারবার তিনি জানিয়েছেন, ইস্টবেঙ্গল একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলেছে । সময় দরকার । সময় দিলে যে জাদু দেখাতে পারেন তা সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্যেই প্রমাণিত । তাই তো গত তিনবছরে ইস্টবেঙ্গলের মিডিয়া টিনের সদস্যরা ডার্বির সাংবাদিক সম্মেলনের আগে সুপার কাপ জয়ের সেলিব্রেশন হিসেবে মিষ্টি বিলোন ।
ক্লাবের শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার প্র্যাকটিসের আগে কোচকে আলিঙ্গন করে হাসিমুখে প্রস্তুতির খবর নেন । লগ্নিকারী ইমামির কর্তা কোচকে অভিনন্দন জানান। আসলে আত্মবিশ্বাস এমন এক সংক্রমণ যা ছবি বদলে দেয় । কার্ড সমস্যার জন্য শৌভিক চক্রবর্তী ডার্বিতে নেই । বোরহা হেরেরা, সিভেরিওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । তা সত্ত্বেও কুয়াদ্রাতের কোনও হেলদোল নেই । বরং যারা আছেন তাদের নিয়ে দল সাজাতে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন । তাই সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রতিভাবান স্ট্রাইকারকে আইএসএলের দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । চার বিদেশিকে প্রথম থেকে ব্যবহারের ইঙ্গিত দিলেন । তবে তা কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার পূর্বাভাস দিলেন না । প্রতিপক্ষ মোহনবাগান সুপারজায়ান্টকে গত তিনটি সাক্ষাতের নিরিখে চেনেন । নতুন কোচের অধীনে এবং জাতীয় দল থেকে সাত ফুটবলারের যোগ দেওয়ার পরে সবুজ মেরুন ব্রিগেড যে দাঁত নখ বের করে আঁচড়াতে চাইবে তা কুয়াদ্রাতের জানা । তাই আস্তিনের তলায় তাস রেখে সমর্থকদের ফের আনন্দ সন্ধ্যা উপহার দেওয়ার কথা বলছেন । সমর্থকদের মন বোঝেন । তাই বলছেন এখন লাল হলুদ সমর্থকরাও চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন,'আমরা চ্যাম্পিয়ন' ।
কোচের মতো অধিনায়ক ক্লেটন সিলভাও ডার্বির মাহাত্ম্য জানেন । গোল করেছেন । তারপর সমর্থকদের প্রত্যাশা চড়েছে সেটা বুঝতে পেরেছেন । ট্রামে বাসে সমর্থকদের ডার্বিতে ফের সাফল্যের আবদার তিনি উপভোগ করছেন । তাই দলকে নিয়ে ফের ডার্বিতে বাজিমাতের কথা লাল হলুদ অধিনায়কের মুখে । কোচ এবং অধিনায়কের শব্দের জাগলারিতে ডার্বি ঘিরে লাল হলুদ প্রস্তুতি মুখোশের আড়ালে থেকে যায় । তবে সেই প্রস্তুতি যে সুপার কাপের আনন্দের রেশ ধরে আত্মতুষ্ট মাখা নয় তা লাল হলুদের প্র্যাকটিসে পা দিলেই টের পাওয়া যায় ।
অন্যদিকে, আইএসএলে টানা তিন ম্যাচে হার । সুপার কাপে প্রাথমিক গণ্ডি না পারার ধাক্কা । চোট আঘাত, জাতীয় দলে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য সাত ফুটবলারের অনুপস্থিতি মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের অন্দরমহলকে জোরালো ধাক্কা দিয়েছে । ইতিমধ্যে কোচ বদল হয়েছে । জুয়ান ফেরান্দোর বিদায়ের পরে আন্তেনিও লোপেজ হাবাস দায়িত্ব নিয়েছেন । আইএসএল বিরতির পরে শুরু হয়েছে । এই অবস্থায় ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান সুপারজায়ান্টের দ্বৈরথ । দুই দলই নতুন স্ট্যান্সে শুরু করছে । ইতিমধ্যে কার্লেস কুয়াদ্রাত বলছেন সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তকমা নিয়ে নামলেও ডার্বিতে তারা ফেভারিট নয় । প্রতিপক্ষ কোচের বাক্য,পরিস্থিতির দিকে নজর আন্তেনিও লোপেজ হাবাসের । আইএসএল জয়ের রেকর্ড রয়েছে । তিনি জানেন কঠিন পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে বের করতে হয় । তাই ঘরের মাঠে ইস্টবেঙ্গলকে সামলানোর আগে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় হাবাস । অধিনায়ক শুভাশিস বসুকে পাশে নিয়ে সবুজ মেরুন চাণক্য মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি ডার্বিতে অপরাজিত । আগের তিন ডার্বিতে কি হয়েছে সেদিকে চোখ দিতে নারাজ । কারণ সেই প্রেক্ষাপট আলাদা ছিল ।
জুয়ান ফেরান্দো দলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে তা সফল হয়নি । তাই এখন জাতীয় দলের দায়িত্ব সামলে সাত ফুটবলারের ফিরে আসার পরের পরিস্থিতি নিয়ে ডার্বির চ্যালেঞ্জ সামলাতে চাইছেন । সুপার কাপের ব্যর্থতার পরে দল নিয়ে বন্ধ দরজার আড়ালে গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি চালিয়েছেন । সেই চেষ্টা কতটা সফল হল তা ডার্বির ফলাফলে ইঙ্গিত দেবে বলে মনে করেন । তবে সাত ফুটবলারের না থাকা বা চোট আঘাত সমস্যাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করতে রাজি নন তিনি । শনিবার ডার্বিতে আশিস রাইকে চোটের জন্য পাবে না মোহনবাগান সুপারজায়ান্ট । কার্ড সমস্যায় নেই লিস্টন কোলাসো । প্র্যাকটিস করছেন সাহাল আবদুল সামাদ এবং আনোয়ার আলি । যা আশা জুগিয়েছে হাবাসকে । প্রথম একাদশ নিয়ে কোনও ইঙ্গিত দেননি । তবে বিরতির পরে ডার্বি থেকেই আইএসএলে নিজেদের ছবিটা উন্নতি করতে চান সেটা বুঝিয়েছেন । কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন আইএসএল লিগ শিল্ড জয় নয় আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হওয়াকে পাখির চোখ করছেন । আশিস রাই চোটের জন্য ছিটকে যাওয়ায় রাইট ব্যাক নিয়ে সমস্যায় মোহনবাগান । প্রতিপক্ষ ইস্টবেঙ্গলের নন্দকুমার ছন্দে রয়েছেন । তিনি কি ফের গোল করে নায়ক হবেন ?
প্রশ্নটা শুনেই অধিনায়ক শুভাশিস জানাচ্ছেন, আগে কী হয়েছে তা তাঁর মনে নেই । আগামিকাল কী হবে তা মাঠে সবাই দেখতে পাবেন । জাতীয় দল ফেরত সাত ফুটবলার এবং হুগো বুমোস, দিমিত্রি পেত্রাতোস, ইউস্তেদের নিয়ে পাশা ওলটানোর লক্ষ্যে ছক সাজাচ্ছেন হাবাস । প্রতিপক্ষ ডাগ আউটে বার্সেলোনার প্রাক্তনী বসে থাকবেন, হাবাস জানেন । একই ঘরানায় বেড়ে ওঠা দুই প্রাক্তনীর ফুটবল বুদ্ধির দ্বৈরথ দেখার অপেক্ষায় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ভিড় জমাবেন সমর্থকরা । হাবাস বলছেন, দ্বৈরথ নয় ৷ এগারো বনাম এগারোর লড়াই । টিকিট নিঃশেষিত । পারদ সপ্তমে । এক দলের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই । অন্য দলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার যুদ্ধ । মাঘ সন্ধ্যায় ডার্বি ঘিরে বঙ্গভঙ্গ ।
আরও পড়ুন :
- বাগান অনুশীলনে কাউকো, ডার্বির ছক সাজাতে হাবাসের চিন্তা দলের ফিটনেস
- পর্দার আড়ালে দলকে তৈরি করছেন, বুমোসকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা হাবাসের
- আইএসএলের প্রথম ডার্বি 3 ফেব্রুয়ারি, ফিরতি বড়ম্যাচ 10 মার্চ