জলপাইগুড়ি, 10 জুন: প্রার্থী বদল করেও আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি ৷ কিন্তু তার পরও সেই জয় নিয়ে গেরুয়া শিবিরের অন্দরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ৷ সেখানে 2019 সালের তুলনায় এবার যেমন বিজেপির জয়ের ব্যবধান কমেছে, তেমনই কমেছে প্রাপ্ত ভোটও ৷ বিজেপির অন্দরে এই নিয়ে বিস্তারিত ‘ময়নাতদন্ত’ চলছে ৷ তবে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন মহল থেকে জন বারলার নামই উঠে আসছে ৷ এবারের নির্বাচনে তাঁকে টিকিট না দেওয়া, প্রার্থী মনোজ টিগ্গাকে নিয়ে তাঁর ক্ষোভ, প্রচার পর্বে তাঁর নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টর হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন ৷ যদিও এই নিয়ে কোনোপক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করতে নারাজ ৷
2019 সালে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার আসনটি প্রথমবার জিতেছিল বিজেপি ৷ জয়ী হয়েছিলেন বিজেপির জন বারলা ৷ তিনি পেয়েছিলেন 7 লক্ষ 50 হাজার 804 ভোট ৷ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী দশরথ তিরকে ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে ৷ তিনি 5 লক্ষ 6 হাজার 815 ভোট পেয়েছিলেন । জন বারলা জিতেছিলেন 2 লক্ষ 43 হাজার 989 ভোটে ৷
পরে জন বারলা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন ৷ কিন্তু এবার তাঁকে প্রার্থী করেনি বিজেপি ৷ বরং প্রার্থী করা হয় মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিগ্গাকে ৷ প্রার্থী না হতে পেরে মনোজ টিগ্গার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সুর চড়িয়েছিলেন জন বারলা । তিনি প্রকাশ্যেই মনোজ টিগ্গাকে প্রার্থিপদ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিয়েছিলেন । এরপর মন গললেও জন বারলা প্রচারে নামেননি । মাত্র একদিন দলীয় প্রার্থীর হয়ে প্রচারে বের হয়েছিলেন জন বারলা । কিন্তু তার পর থেকে তাঁকে বিজেপির প্রচারে নামতে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ ।
ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা যায় বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগ্গা পেয়েছেন 6 লক্ষ 95 হাজার 314 ভোট ৷ দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকাশ চিক বরাইক 6 লক্ষ 19 হাজার 867 ভোট পেয়েছেন ৷ 75 হাজার 447 ভোটে জয়ী হন মনোজ টিগ্গা ৷ গতবারের চেয়ে প্রায় দেড় লক্ষ ভোট কম পেয়েছে বিজেপি ৷ জয়ের ব্যবধানও প্রায় দেড় লক্ষ কম হয়েছে বিজেপির ৷
আলিপুরদুয়ার লোকসভার অধীনে যে সাতটি বিধানসভা রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত ৷ সেগুলি হল - আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, কালচিনি, মাদারিহাট ও কুমারগ্রাম ৷ এছাড়া কোচবিহারের তুফানগঞ্জ ও জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা বিধানসভাও রয়েছে আলিপুরদুয়ার লোকসভার মধ্যে ৷ ছ’টি বিধানসভায় লিড পেলেও নাগরাকাটায় পিছিয়ে রয়েছে বিজেপি ৷ সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে 83 হাজার 279 ভোট ৷ বিজেপি 79 হাজার 732 ভোট পেয়েছে । 3 হাজার 547 ভোটে নাগরকাটা বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেসে এগিয়ে ।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই নাগরাকাটা বিধানসভা এলাকাতেই বাড়ি জন বারলার ৷ মূলত, চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকা ৷ এখানে জন বারলার ভালো প্রভাব রয়েছে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের ৷ আর বারলার ‘গোঁসা’র ফল ইভিএমে পড়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল ৷ যদিও জন বারলা নিজে বলছেন, ‘‘আমি আমার কাজ করেছি । কেন ভোট কমল, তা খতিয়ে দেখতে হবে ৷’’
এই নিয়ে এখনই কাউকে দোষারোপ করতে নারাজ আলিপুরদুয়ার থেকে সদ্য জয়ী মনোজ টিগ্গাও ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি জন বারলা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছেন । জন বারলা নিজের মতো করে সহযোগিতা করেছেন । ঘরে বসেই হোক, দুই চার জায়গায় ঘুরেই হোক । সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে বিজেপি সারা বছর সংগঠন করে । সংগঠনের ওপরেই ভোট হয়েছে । তিনি যতটুকু সাহায্য করার কথা করেছেন । চা-বাগানের শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি ন্যূনতম মজুরি । চা-শ্রমিকদের দাবি পূরন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই ৷’’
তবে জন বারলার এই ‘অভিমান’-এর প্রভাব যে শুধু আলিপুরদুয়ারে পড়েছে, তা নয় ৷ জলপাইগুড়িতেও প্রভাব দেখা গিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন ৷ জলপাইগুড়ি লোকসভার অধীনেই রয়েছে মালবাজার বিধানসভা ৷ ওই এলাকায় চা-বলয় অধ্য়ুষিত ৷ সেখানেও বারলার প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে বলেন ৷ সেই কারণে কি সেখানেও পিছিয়ে ছিলেন বিজেপির জয়ন্ত রায় ? মালবাজারে এবার তৃণমূল কংগ্রেস 12 হাজার 815 ভোটে এগিয়ে রয়েছে ৷
এর জেরে জলপাইগুড়ির সামগ্রিক ফলে পড়েছে ৷ ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী জয়ন্ত রায় 7 লক্ষ 66 হাজার 568 ভোট পেয়েছেন । তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায় পেয়েছেন 6 লক্ষ 69 হাজার 875 ভোট । জয়ন্ত রায় জিতেছেন 86 হাজার 693 ভোটে ৷ 2019 সালে জয়ন্ত রায় পেয়েছিলেন 7 লক্ষ 60 হাজার 150 ভোট । তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী পেয়েছিলেন 5 লক্ষ 76 হাজার 141 ভোট । 1 লক্ষ 84 হাজার 4 ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ৷ 2019-এর তুলনায় জয়ন্ত রায় 97 হাজার 311 ভোট কম পেয়েছেন । জয়ের ব্যবধানও প্রায় এক লক্ষ কমেছে ৷
এক্ষেত্রেও জন বারলা ফ্যাক্টর হয়েছেন বলে অনেকের ধারণা ৷ এই নিয়ে বিজেপির জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি বাপী গোস্বামী বলেন, ‘‘আমাদের সাংগঠনিক জেলার মালবাজারে বেশ কিছু চা-বাগানে আমরা ভালো ফল করলেও কয়েকটি চা-বাগানে খারাপ ফল হয়েছে । কেন এমন ফল হল, এর কারণ জন বারলা কি না, তা বুথভিত্তিক ফলাফল পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে । নাগরাকাটা বিধানসভা ও আলিপুরদুয়ারের লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্ব ভোটের কাজ পর্যালোচনা করেছে । সেই বিষয়ে তাঁরাই বলতে পারবেন ।’’
রাজনৈতিক মহলের মতে, সদ্য় ফল প্রকাশিত হয়েছে ৷ এখনও ফল নিয়ে অনেক কাঁটাছেড়া বাকি রয়েছে ৷ তখন এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে ৷ সত্যি যদি জন বারলা ফ্যাক্টর হন, তাহলে সেই নিয়ে বিজেপিও পরবর্তী কী পদক্ষেপ করে, সেদিকেও নজর থাকবে সকলের ৷