ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া অর্থনীতি হতে পারে ৷ কিন্তু এটা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে না । এটা হচ্ছে মূলত শিল্পবিপ্লব সৃষ্টি করতে ব্যর্থতার কারণে । যাই হোক, সম্প্রতি একটি সাফল্যের গল্প সামনে এসেছে, যা আমাদের শাসক ও নীতিনির্ধারকদের মনে থাকা ভুল ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে । এর থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে এবং এর ভিত্তিতে ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে ৷ অন্যান্য শ্রমক্ষেত্রে কি এই সাফল্যকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে ?
1991 সাল থেকে ভারত সুন্দরভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে, তিন দশক ধরে বছরে প্রায় 6 শতাংশ । এর ফলে মধ্যবিত্তের সংখ্যা জনসংখ্যার নিরিখে 10 শতাংশ থেকে 30 শতাংশে উন্নীত করেছে ৷ পাশাপাশি 450 মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে এনেছে । পরিষেবার ক্ষেত্রে ভারত ব্যতিক্রমীভাবে ভালো ফল করেছে ৷ এই ক্ষেত্রে কার্যত বিশ্বের ব্যাক-অফিসে পরিণত হয়েছে ভারত । কিন্তু উৎপাদন ক্ষেত্র ব্যর্থ হয়েছে ৷ এই ক্ষেত্রের অবদান জিডিপি-র 15 শতাংশের কম ৷ জনসংখ্যার 11 শতাংশ এই ক্ষেত্রে কাজ পেয়েছে ৷ সারা বিশ্বে রফতানির মাত্র 2 শতাংশে অবদান রেখেছে ৷ তবে কোনও দেশই এ ছাড়া দারিদ্র্য থেকে উঠে আসেনি । পূর্ব এশিয়ার সফল দেশ বলে পরিচিত জাপান, কোরিয়া ও তাইওয়ান উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্রম বাড়ানোর মন্ত্রে রফতানি করেছে । চিন এর সর্বশেষ উদাহরণ ।
ভারতের সমস্যা বেকারত্ব নয়, কম কর্মসংস্থান । তাই, বিভিন্ন সময়ে হওয়া শ্রম-সমীক্ষায় চাকরির সংকটের পরিমাণ প্রতিফলিত হয় না । অনেক তরুণ-তরুণী কম উৎপাদনশীলতায়, বিভিন্ন সংস্থায় বা বাজারে অনানুষ্ঠানিক চাকরি করে ৷ কিন্তু সেই কাজগুলিতে উৎপাদন বেশি হয় ৷ সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের সময়ে বিভিন্ন সমীক্ষায় ভালো চাকরি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি সামনে এসেছিল ৷ যার প্রভাব কিছুটা হলেও ভোটে পড়েছিল ৷
তবে ভালো খবরও আছে । বিশ্বব্যাপী সরবরাহের জন্য একটি শীর্ষস্তরের দেশ ভারতকে তাদের পণ্যের দ্বিতীয় উৎপাদক দেশ হিসাবে বেছে নিয়েছে । অ্যাপলের আইফোন 2021 সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে চিনে তৈরি করা হতো ৷ এখন, তা ভারতে দেড় লক্ষ প্রত্যক্ষ চাকরি (70 শতাংশ মহিলা) এবং আনুমানিক সাড়ে 4 লক্ষ পরোক্ষ চাকরি তৈরি করেছে ৷ 14 বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ফোন তৈরি করা হয়েছে এবং বছরে 10 বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি হচ্ছে ৷ এটি আইফোনের বৈশ্বিক উৎপাদনের মাত্র 14 শতাংশ, যা 2026 সালের মধ্যে 26 শতাংশ থেকে 30 শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছে জেপি মরগ্যান । তামিলনাড়ুতে এই সংস্থার কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরির কাছাকাছি বিশাল ডরমিটরি তৈরি হচ্ছে, যাতে মহিলা শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ দেওয়া যায় ।
একটি কার্যকর রফতানিকারক হাব হওয়ার জন্য ভারতকে এখনও আইফোনের উপাদান নির্মাতাদের আকৃষ্ট করতে হবে, যারা 85 শতাংশ মূল্য সংযোজন করে । তারা বেশিরভাগই চিনা । তারা আরও অনেক বেশি চাকরি তৈরি করবে, আরও দক্ষতা দেবে এবং আরও প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে । শুধুমাত্র এইভাবে আমাদের এমএসএমইগুলি গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের সঙ্গে যুক্ত হবে । বছরখানেক আগের মারুতির ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে । এর ফলে চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে । সুতরাং, চিনা অ্যানসিলিয়ারি সংস্থাগুলিকে অনুমতি দেওয়া আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য জরুরি । অন্যথায়, ভারতে বিক্রি হওয়া প্রতিটি মোবাইল চিনে চাকরি তৈরি করতে থাকবে ।
এখান থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে । প্রথমত, ভারত একটি বড় বাজার, এই ভুল ধারণা ত্যাগ করতে হবে ৷ এখানে বড় জনসংখ্যা রয়েছে, যাদের ক্রয় ক্ষমতা কম । বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডগুলি 'মেক ইন ইন্ডিয়া'-এর জন্য সারিবদ্ধ হচ্ছে, এই বিশ্বাসও ভুল ৷ ভারতে যখন অ্যাপল ফোন বিশ্বব্যাপী বিক্রির নিরিখে মাত্র 0.5 শতংশ বিক্রি হতো, তখন এই সংস্থা ওই ফোন ভারতে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় । সংবেদনশীল সরকারি আলোচকদের দ্বারা আইফোনের প্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়েছিল ৷ কারণ, ওই মধ্যস্থতাকারীরা কোম্পানির চাহিদা নিয়ে নমনীয় হয়ে আলোচনা করে ৷
এর দ্বিতীয় শিক্ষা হল যে কোনও দেশই তার অভ্যন্তরীণ বাজার দিয়ে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না । চিনের বড় বাজার থাকা সত্ত্বেও সাফল্যের জন্য রফতানি প্রয়োজন হয় ৷ উচ্চ শুল্কের মাধ্যমে সুরক্ষা-সহ আমদানি প্রতিস্থাপন ছিল 1960-এর দশক থেকে চলা ভারতীয় ধারণা ৷ এই ধারণা খুবই খারাপ৷ এটা একটি রোগের মতো টিকে আছে, যা ভারতকে বিশ্বের ট্যারিফ চ্যাম্পিয়ন করে তুলেছে । প্রতিযোগিতামূলক স্তরে তার শুল্ক হ্রাস না করলে, ভারত বিশ্বব্যাপী মূল্য শৃঙ্খলে যোগদানের আশা করতে পারে না, যা বিশ্ব বাণিজ্যে 24 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পণ্যের 70 শতাংশ জোগান দেয় ৷ এইভাবে প্রতিটি পিএলআই স্কিমে উচ্চ শুল্কের উপর একটি সানসেট ক্লজ থাকা উচিত ।