দেবেন্দ্র পুলা ও চক্রধর যাদব
ভোটমুখী ভাতা দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। আঞ্চলিক পরিচিতি ছেড়ে এটি এখন সর্বভারতীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ু থেকে শুরু হলেও এখন দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সমস্ত রাজনৈতিক দলই জনমোহিনী ঘোষণা করছে। মহারাষ্ট্র এবং দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন অথবা গত বছরের লোকসভা নির্বাচন-প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভোটমুখী ভাতা নির্বাচনের অন্যতম বড় অংশ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলিকে সুবিধে করে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে অবশ্য অর্থনীতির ক্ষতি করছে এই ভাতা।
ভোটমুখী ভাতার শুরু এবং বিস্তার
মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে ভোটমুখী ভাতার ঘোষণা করেছিল সমস্ত রাজনৈতিক দল। ব্যাঙ্কে সরাসরি অর্থ পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে বিনা খরচে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া অথবা বেকার ভাতা এবং ঋণ মুকুবের মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলি। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনও এগিয়েছে একই পথে। 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনেও এই প্রবণতা চোখে পড়েছিল। আঞ্চলিক দলের পাশাপাশি জাতীয় দলগুলিও ভোটারদের খুশি করতে একাধিক প্রকল্পের ঘোষণা করেছিল। আর তা যে যথার্থ আর্থিক উন্নয়নের জন্য নয়, শুধুই ভোটে জেতার উপায়-তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বছর তিনেক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রকাশ্যে এই ভোটমুখী প্রকল্প ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর ভাষায় এটি ছিল 'রেবরি কালচার'। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই বিজেপিকেও অন্য রাজনৈতিক দল গুলির মতো সরাসরি অর্থ সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল। 2022 সালের উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। বিজেপির এই অবস্থান পরিবর্তন একটা ব্যাপার বুঝিয়ে দেয়। তা হল, রাজনৈতিক দলগুলিও বুঝতে পেরেছে এই ধরনের ঘোষণা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। তবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কাছে তাদের বারবার হারতে হচ্ছে।
অর্থনীতির উপর প্রভাব: ধার এবং অনিয়ন্ত্রিত খরচ
এখানে দেশের মধ্যে চারটি রাজ্যের কথা আলাদা করে বলা দরকার। অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ - এই চারটি রাজ্যে রাজস্ব ঘাটতি ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছেছে। নীতি আয়োগের ফিসকাল হেলথ ইনডেস্ক বলছে গত এক দশকে এই চারটি রাজ্যে যে দলেরই সরকার থাকুক না কেন তারা ভোটমুখী ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে সদয় ছিল। তারই প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে।

রাজনৈতিক দলগুলির অবশ্য নিজস্ব যুক্তি আছে। ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের যুক্তি-এটা মানুষের চাহিদা। নেতারা দাবি করেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনায় তাঁরা জানতে পেরেছেন, এভাবে সরাসরি অর্থ সাহায্য করলে গরিব মানুষের উপকার হয়। তবে রাজনৈতিক নেতাদের এই বক্তব্য অর্থনীতির যুক্তির সঙ্গে মানানসই নয়, শুধুই তোষণের রাজনীতি। এভাবে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং মূল্যায়ন ছাড়া ভাতা দেওয়ার প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক হয়। সাধারণ মানুষের জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসে না। বাজার-অর্থনীতির এখানে এক বিশেষ ভূমিকা আছে। পরিষেবা বিনা খরচে দেওয়া হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে চাহিদা ও যোগান ব্যবস্থার উপর। আর তার জেরে বেসরকারি সংস্থা বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ হারায়।
স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেকটাই কমে যেতে পারে এই ভাতার জন্য। পাশাপাশি এভাবে ভাতা দিলে কাজের ব্যাপারে আগ্রহ হারাবার প্রবণতা তৈরি হয়। এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধে পাওয়ার ব্যাপারেও বৈষম্য তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটা রাজনৈতিকভাবে কাউকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কারণে হতে পারে। আবার সুবিধে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক গাফিলতির কারণেও হতে পারে। আর তা যদি হয় তাহলে সমাজে বৈষম্য আরও বাড়ে। ক্ষনিকের ভালোর জন্য সুদূরপ্রসারি উন্নয়নকে অবহেলা করার মানসিকতা তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, ভোটমুখী ভাতা রাজনৈতিক দলগুলিকে নীতি নির্ধারণের সময় শুধুই নির্বাচনী লাভ-ক্ষতি নিয়ে ভাবায়। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্ন সেখানে আলোচিত হয় না।
কোড অফ কন্ডাক্ট তৈরি করা দরকার
কয়েকদিন আগে সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড সোশ্যাল স্টাডিজের একটি অনুষ্ঠানে প্রাক্তন আরবিআই গভর্নর ডি সুব্বারাও বলেন, "রাজনৈতিক দলগুলি যাতে ভোটমুখী ভাতা ঘোষণার ক্ষেত্রে সাবধানী হয় তার জন্য কোড অফ কন্ডাক্ট থাকা দরকার।" কিন্তু এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে এই বিষয়টি ঠিকঠাক ভাবে মানা হচ্ছে কি না তা নির্ধারণ করতে আইন থাকা দরকার। নির্দিষ্ট আইন ছাড়া কোনও কোড অফ কন্ডাক্ট তৈরি করেই লাভের লাভ হবে না। এই নিয়ম-নীতি নিশ্চিত করবে রাজনৈতিক দল গুলি ভোটের আগে যে সমস্ত ঘোষণা করবে তার কোনওটাই আর্থিকভাবে অসম্ভব নয় এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারকও নয়।
ভোটমুখী ভাতা এবং কর্মসংস্থান
চিনের দার্শনিক লাউত জু বলতেন, "কোন এক ব্যক্তিকে একদিন মাছ দিলে তার সেই দিনটা কেটে যাবে। কিন্তু তাকে মাছ ধরতে শেখালে তার গোটা জীবনটাই ভালোভাবে কাটবে।" এই কথাটা এক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের বুঝতে হবে, তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের কথা না ভেবে নীতিগত উন্নয়নে মনোনিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। শুধুই ভোটের কথা ভেবে একের পর এক ঘোষণা করে গেলে তার কু-প্রভাব পড়বে ভারতের অর্থনীতির উপর। ভারতীয় অর্থনীতি এই ধরনের কু-প্রভাবের মুখোমুখি হওয়ার পরিস্থিতিতে নেই। নীতি নির্ধারকদের বুঝতে হবে, কর্মসংস্থানের নির্দিষ্ট পরিকাঠামো তৈরি করার মধ্য দিয়ে দেশের জনগণকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা যায়। তাঁদের দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করার বিষয়টিকে রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। আর তাই রাজনৈতিক শ্রেণীর ভোটমুখী ভাতা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।