কলকাতা, 2 অক্টোবর: মহালয়ার ভোর হয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুনে ৷ তবে একবার রেডিয়োতে উঠে আসে মহানায়ক উত্তম কুমারের কণ্ঠ ৷ মহানায়কের সেই প্রয়াস মেনে নেয়নি বাঙালি শ্রোতারা ৷ আর সেকথা নিজেও জানতেন উত্তম কুমার স্বয়ন ৷ এমনটাই ইটিভি ভারতকে জানালেন মহানায়কের ভাইঝি মৌসুমী দত্ত। মহানায়কের মেজ ভাই বরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে মহালয়ার দিন ফিরলেন ফেলে আসা 'উত্তম স্মৃতি'তে ৷
তিনি বলেন, "উনি তো নিজেই রাজি ছিলেন না মহালায়ার অনুষ্ঠান করতে। উনি বুঝেছিলেন কেউ মেনে নেবেন না তাঁর কণ্ঠ। উনি মানুষের পালস রেট বুঝতেন। উনি ওনার জায়গায় সেরা। আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর নিজের জায়গায় সেরা। যেটা নিজের পক্ষে সম্ভব নয়, সেদিকে পা বাড়াতেন না তিনি। কিন্তু অসীমা মুখোপাধ্যায় এসে খুব অনুরোধ করেন। তাতেও রাজি ছিলেন না জেঠু। এরপর হেমন্ত জেঠু (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) এসে রাজি করান আমার জেঠু উত্তম কুমারকে। জেঠু মাত্র 150 টাকা পেয়েছিলেন মহালয়ার পারিশ্রমিক হিসেবে।ওটা তো ওনার মতো মানুষের পারিশ্রমিক হতে পারে না। তবু উনি আপত্তি করেননি। মনে রাখতে হবে সেই সময় জেঠুর কেরিয়ারগ্রাফ তুঙ্গে।"
তিনি আরও জানান, "এই অনুষ্ঠানের জন্য একেবারেই সময় পাননি রিহার্সালের। আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র'র মহালয়ায় ছিল অনেক বড় কর্মকাণ্ড। অনেক অনুশীলন। জেঠুর কণ্ঠের মহালয়াতে খুব কমই ভাষ্য ছিল। এক ঘণ্টার মধ্যে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যায়। মহালয়ার দিন সেটা আকাশবাণীতে অন এয়ার হওয়ার পর উত্তম বিরোধীরা কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিলেন জেঠুকে। কিন্তু পারেননি। তারা 'উত্তমকুমারের মহালয়া' বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানটিকে। জেঠু নিজেই আকাশবাণীকে অনুরোধ করেন, ষষ্ঠীর দিন যেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র'র কণ্ঠের 'মহিষাসুরমর্দিনী' বাজানো হয় রেডিয়োতে। আকাশবাণী শুনেছিল জেঠুর কথা। আমার বয়স তখন ষোলো।"
প্রসঙ্গত, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আকাশবাণী কলকাতার জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। বছরের পর বছর ধরে বাঙালির আবেগ এই 'মহিষাসুরমর্দিনী'। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমার এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
জানা যায়, এই অনুষ্ঠান যত জনপ্রিয় হতে থাকে ততই এটিকে ঘিরে তৈরি হয় নানান বিতর্ক। আর বিতর্ক গড়ে তোলেন তখনকার দিনের গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজ।
তাঁরা বলেছিলেন যে, মহালয়ার ভোরে অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার কোনও যৌক্তিকতা নেই। সেই প্রতিবাদের পর এই অনুষ্ঠানকে সরিয়ে ষষ্ঠীর ভোরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শ্রোতাকূলের প্রতিবাদে ফের অনুষ্ঠানটিকে মহালয়াতেই বাজানো শুরু হয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠেই। অর্থাৎ ধর্মীয় গোঁড়ামিকে ভেঙে দিয়ে বাঙালি শুনতে চেয়েছিলেন বীরেন ভদ্রের সেই কালজয়ী কণ্ঠ।
প্রভাতী অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে ঠিক সেইসময় (1976 সাল) আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন এই অনুষ্ঠান বাতিল করে অন্য অনুষ্ঠান বাজানো হবে মহালয়ায়। অনুষ্ঠানটির নাম- ‘দেবীদুর্গতিহারিণীম্’, লিখেছিলেন ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। আর ভাষ্যপাঠে উত্তমকুমার।
তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্থানে মহানায়ককে একেবারেই গ্রহণ করেননি শ্রোতাকূল। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে বাদ দেওয়ার জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। শোনা যায়, উত্তমকুমারের কাছে মহালয়া করার প্রস্তাব এলে তিনি প্রথমে তো রাজিই হননি এবং যখন কাজটা করতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র'র কাছে গিয়ে নিজের অস্বস্তি এবং অযোগ্যতার কথাও জানিয়েছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আর সম্প্রচারের দিন খাটে বসে ছেলের সঙ্গে মন দিয়ে শুনেছিলেন উত্তমকুমারের মহালয়া। সবটা শোনার পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছিলেন, "লোকে যদি নেয় নিক।"