কলকাতা, 22 অগস্ট: ঝাড়গ্রামে হাতি মৃত্যুর পর এবার নড়েচড়ে বসল বন দফতর ৷ ঝাড়গ্রামের ঘটনা নিয়ে বন দফতরের তরফে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করা হয়। সেই বৈঠকে হাতি বাঁচতে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ এর মধ্যে যেমন 'হুলা পার্টি'র কাজে নিযুক্ত কর্মীদের সঠিক প্রশিক্ষণ থেকে তাঁদের জীবন বীমা পর্যন্ত একাধিক পদক্ষেপ করার কথা ভাবনাচিন্তা করেছে বনদফতর ৷ এ কথা ইটিভি ভারত-কে জানিয়েছেন রাজ্যের বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা ৷
মন্ত্রীর কথায়, এ ধরনের ঘটনা কোনওভাবেই কাঙ্খিত নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলে এই ঘটনাগুলি ঘটে ৷ আমরা চেষ্টা করছি, কিছু প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এই মৃত্যুর ঘটনা যাতে এড়ানো যায়। আমাদের দফতর এ নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে ৷ সেই বৈঠকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷
তিনি বলেন, "হাতির গতিপথ কোনওভাবেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না ৷ কিন্তু এভাবে হাতি দেখা গেলে কয়েকহাজার মানুষ সেখানে ভিড় করেন। বনদফতরের কর্মীরা সেখানে থাকলেও তাঁদের কাজ করতে অসুবিধা হয়। তাই আগামী দিনে যদি এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষকে ভিড় করতে দেখা যায়, সেক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ৷ আমরা দেখছি, এই বিষয় নির্দিষ্ট বন দফতরের কোনও আইনে রয়েছে কি না ৷ যদি না-থাকে তাহলে, নতুন আইন তৈরির বিষয়েও ভাবনাচিন্তা করা হবে ৷
একইসঙ্গে দফতরের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এতদিন পর্যন্ত হাতি তাড়ানোর কাজে যুক্ত থাকা হুলা পার্টির সদস্যদের বছরে একবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। এবার থেকে তাঁদের দু'বার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ৷ যাতে তাঁরা এই কাজে আরও পারদর্শী হতে পারেন। তিনি এও জানিয়েছেন, এদের নির্দিষ্ট ড্রেস বা পোশাক দেওয়ার বিষয়ও ভাবনাচিন্তা করছে রাজ্য সরকার ৷ যাতে সাধারণ নাগরিকের থেকে বনদফতরের কর্মীদের আলাদা করা যায় ৷ এতদিন পর্যন্ত এরা সাধারণ পোশাকেই মানুষের সঙ্গে মিশে থাকত, ফলে কে সাধারণ মানুষ, কে হুলা পার্টির লোক, বোঝা যেত না।
একইসঙ্গে যেহেতু হুলা পার্টির সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, প্রতিমুহূর্তে তাই তাঁদের জীবন বিমার বিষয়টিও ভাবনা চিন্তা করছে রাজ্য সরকার। তিনি আরও জানান, গতকালের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এবার বিভিন্ন জেলায় থাকা বনকর্মীদের বডি ক্যামেরা দেওয়া হবে। তা সরাসরি সার্ভারের মাধ্যমে দফতরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ৷ যাতে এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে, দ্রুত খবর দফতরে পৌঁছয় ৷ তিনি এও জানিয়েছেন, এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষকে বন দফতরকে কাজ করার জন্য সহযোগিতা করতে হবে। সেজন্য তিনি সাধারণ মানুষের সাহায্যও চেয়েছেন মন্ত্রী ৷
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা দিবসের সকালে দুবরাজপুর হয়ে শাবক-সহ পাঁচটি হাতির একটি দল ঝাড়গ্রাম শহরের বিদ্যাসাগরপল্লী এলাকায় ঢুকে পড়ে ৷ হাতির দলে থাকা একটি পুরুষ হাতির আক্রমণে একজন শহরবাসীর মৃত্যু হয় ৷ তারপরেই বন দফতর ঘুম পাড়ানি গুলি করে পুরুষ হাতিটিকে পাকড়াও করে জঙ্গলে ছেড়ে দেয় ৷ বাকি চারটি হাতি আশ্রয় নেয় নতুন জেলা শাসকের অফিসের পাশে থাকা পরিত্যক্ত প্রাণিসম্পদ দফতরে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটি ছোট্ট জঙ্গলে ৷ হাতি দেখার জন্য শহরবাসীর ভিড় উপছে পড়েছিল চারিদিকেই ৷ এই অবস্থায় বন দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সূর্যের আলো নামার পর এই চারটি হাতিকে ড্রাইভ করে জঙ্গলে পাঠানো হবে।
কিন্তু বিকেলের পর চিত্রটা বদলে যায়। হুলা পার্টির সদস্যরা হাতি গুলিকে জঙ্গলে পাঠানোর জন্য কাজে নেমে পড়ে। দলটির সঙ্গে শাবক থাকায় স্ত্রী হাতিটি উত্তেজিত অবস্থায় ছিল ৷ হাতিটিকে বাগে আনার জন্য হুলা পার্টির এক সদস্য পরিত্যক্ত একটি একতলা বাড়ির উপর উঠে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর হাতিকে জ্বলন্ত শলাকা ছুড়ে মারে ৷ যা হাতেটির মেরুদন্ডে গিয়ে আটকে যায় ৷ মেরুদন্ডে জ্বলন্ত হুলার শলাকা ঢুকে যেতেই কাতর চিৎকার শুরু করে স্ত্রী হাতিটি ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পিছনের দুটি পা অবশ হয়ে যায়। তারপরেই দীর্ঘ চেষ্টার পর নিজে শুঁড় দিয়ে শলাকাটিকে ধরে শরীরের বাইরে থেকে বার করে ছুড়ে ফেলে দেয় স্ত্রী হাতিটি ৷
এর পর হাতিটি অচৈতন হয়ে গেলে তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলমহল জুলজিক্যাল পার্কে ৷ চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরের দিন অর্থাৎ 16 অগস্ট হাতিটির মৃত্যু হয় ৷ 17 অগস্ট হাতিটির ময়নাতদন্ত হয় ৷ ময়নাতদন্তের পরেই সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ, হুলা পার্টির জ্বলন্ত শলাকায় বিদ্ধ হয়ে একটি হাতির নয়, দু'টি হাতির মৃত্যু হয়েছে ৷ হাতিটি অন্তঃসত্ত্বা ছিল বলেও দাবি করা হয় ৷ যদিও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে হাতিটি অন্তঃসত্ত্বা ছিল কি না, সেই প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করেনি বন দফতর ৷ ঘটনায় ঝাড়গ্রাম থানায় এফআইআরও করা হয়েছিল বন দফতরের তরফে ৷ এই ঘটনায় 2 জন হুলা পার্টির সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।