নয়াদিল্লি: রাষ্ট্রসংঘের উচ্চ সমুদ্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত ৷ আগামী মাসে নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের 79তম অধিবেশন রয়েছে ৷ সেখানেই এই চুক্তিতে সাক্ষর করবে ভারত ৷ নয়াদিল্লি যে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় যোগ দিতে চলেছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হিসাবে এই সিদ্ধান্তকে দেখা যেতে পারে । মঙ্গলবার চেন্নাইতে দু’দিনের একটি কর্মশালার উদ্বোধনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের উপদেষ্টা পিকে শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন যে চুক্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে তদারকি করার জন্য একটি ব্যবস্থা তৈরি করা হবে, যা শুধুমাত্র এই কাজ করবে ৷
শ্রীবাস্তব বলেন, "এই কর্তৃপক্ষ চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় নিয়ম, সমীক্ষা এবং অন্যান্য বিষয়গুলি দেখবে ৷’’ তিনি আরও জানান, এই চুক্তিকে কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করতে হলে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন এবং বিদ্যমান আইনে পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে ৷
তিনি জানান, পরিবেশ সুরক্ষা আইন 1986-কে চুক্তির পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে । গত মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই চুক্তি করার বিষয়টিতে অনুমোদন দিয়েছে ৷
ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল অফ দ্য় সি বা ইউএনসিএলওসএস-এর অধীনে যে তিনটি চুক্তি রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল রাষ্ট্রসংঘের উচ্চ সামুদ্রিক চুক্তি ৷ অন্য দু’টি হল 1994 সালের পার্ট 11 বাস্তবায়ন চুক্তি (যা আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল এলাকায় খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান এবং নিষ্কাশনের অনুমতি দেয়) এবং 1995 সালের রাষ্ট্রসংঘের মাছের মজুদ চুক্তি (যা স্ট্র্যাডলিং এবং উচ্চ পরিযায়ী মাছের মজুদের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অনুমোদন দেয়) ।
ইউএনসিএলওএস কী ?
1982 সালে ইউএনসিএলওএস তৈরি হয় ৷ 1994 সালের 16 নভেম্বর কার্যকর হয়৷ এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা সম্পদ এবং সামুদ্রিক পরিবেশের সংরক্ষণ ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করে বিশ্বের সমুদ্র এবং মহাসাগরগুলির ব্যবহারের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করেছে ৷ সমুদ্রের জীবন্ত সম্পদের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতেই ইউএনসিএলওএস তৈরি করা হয় ৷ সার্বভৌমত্ব, সামুদ্রিক অঞ্চলে ব্যবহারের অধিকার এবং নৌ চলাচলের অধিকারের মতো অন্যান্য বিষয়গুলিও ইউএনসিএলওএস-এর অধীনে রয়েছে ।
রাষ্ট্রসংঘের উচ্চ সমুদ্র চুক্তি কী ?
কোনও দেশের এক্তিয়ারের বাইরে থাকা সামুদ্রিক অঞ্চলকেই উচ্চ সমুদ্র বলে ৷ মহাসাগরের 64 শতাংশ ও পৃথিবীর অর্ধেকই উচ্চ সমুদ্রের মধ্য়ে পড়ে ৷ এর পরিবেশগত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলগুলি মূলত অনিয়ন্ত্রিত হয়ে রয়েছে ৷ মাছ ধরা ও দূষণের মতো নির্দিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণে চালু থাকা আন্তর্জাতিক নিয়মের আওতায় এই অঞ্চল পড়লেও এখানকার জীববৈচিত্র্য পরিচালনার জন্য কোনও বিস্তৃত কাঠামো নেই । এই নিয়ন্ত্রণের অভাবে সম্পদের অত্যধিক শোষণ, আবাসস্থল ধ্বংস করা ও সামুদ্রিক প্রজাতির জন্য সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ৷ এর মধ্যে কতগুলি বিষয় তো ভালোভাবে বোঝাই যায় না ৷
2017 সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে কোনও দেশের এক্তিয়ারের বাইরের সামুদ্রিক অংশের জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং তার দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের বিষয়টি একটি আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয় ৷ তাই তা নিয়ে আলোচনার জন্য একটি আন্তঃসরকারি সম্মেলন ডাকার পক্ষে সাধারণ পরিষদে ভোট দেয় সবাই । এটি প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়েছিল ৷ কারণ, ইউএনসিএলওএস কোনও দেশের বাইরের অঞ্চলগুলির জন্য কোনও কাঠামো তৈরি করেনি ৷ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং বিশ্বব্যাপী মাছের মজুত ও অতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতার উপর প্রভাবের জন্য বিশেষ উদ্বেগ ছিল ।
উচ্চ সমুদ্রে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদে তা পরিচালনা করতেই তৈরি হয় রাষ্ট্রসংঘের উচ্চ সমুদ্র চুক্তি ৷ এটাকে বায়োডাভারসিটি বিয়ন্ড ন্যাশনাল জুরিসডিকশন (বিবিএনজে) চুক্তি নামেও পরিচিত ৷ এটিকে একটি যুগান্তকারী আন্তর্জাতিক চুক্তি হিসেবেও দেখা হয় ৷ 2023 সালের 4 মার্চ রাষ্ট্রসংঘে একটি আন্তঃসরকারি সম্মেলন হয় ৷ তখনই বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছিল ৷ ওই বছর 19 জুন বিষয়টি গৃহীত হয়েছিল ৷ রাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একত্রীকরণ সংস্থা, উভয়ই এই চুক্তির অংশ হতে পারে ৷
রাষ্ট্রসংঘের উচ্চ সমুদ্র চুক্তিতে কোন বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত ?
এই চুক্তির মধ্য়ে মূলত চারটি প্রধান বিষয় রয়েছে: মেরিন জেনেটিক রিসোর্স (এমজিআর) ও তাদের ডিজিটাল সিকোয়েন্সের তথ্য ৷ এর মধ্যে সুবিধার ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত ভাগাভাগিও রয়েছে ৷ সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা-সহ এলাকা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা সরঞ্জাম (এবিএমটিএস)৷ পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএএস) এবং সামুদ্রিক প্রযুক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্থানান্তর (সিবি অ্য়ান্ড টিএমটি) ।
মেরিন জেনেটিক রিসোর্স কী ?
চুক্তিতে উল্লিখিত প্রথম উপাদানে অন্তর্ভুক্ত থাকা ন্যায্য সুবিধা ও ন্যায়সঙ্গত ভাগাভাগিই হল মেরিন জেনেটিক রিসোর্স ৷ এছাড়া মেরিন জেনেটিক রিসোর্স জৈব রাসায়নিক উৎপাদন সক্ষম করতে পারে ৷ যা প্রসাধনী, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং খাদ্য সম্পূরকগুলিতে ব্যবহার করা যেতে পারে । সম্পদের অর্থনৈতিক মূল্য আপাতত অস্পষ্ট ৷ কিন্তু লাভের সম্ভাবনা স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সম্পদ অনুসন্ধান ও সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধিতে আগ্রহ তৈরি করেছে ।
রাষ্ট্রসংঘের আলোচনার সময় বিতর্ক হয় সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদগুলি 'মাছ' এবং 'মাছ ধরার কার্যকলাপে' প্রয়োগ করা উচিত কি না । যদি তা না হয়, তবে এটি উচ্চ সমুদ্র চুক্তির উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে ৷ কারণ, মাছ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের একটি প্রধান উপাদান এবং কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতায় একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে । তবে, চূড়ান্ত চুক্তিতে বলা হয়েছে যে মেরিন জেনেটিক রিসোর্সের নিয়ম কোনও দেশের এক্তিয়ারের বাইরের অঞ্চলে 'মাছ' এবং 'মাছ ধরার' ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ।
এবিএমটি কী ?
এবিএমটি সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা (এমপিএ)-সহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের মূল হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত । এগুলি কোনও দেশের এক্তিয়ারের বাইরে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা রক্ষা, সংরক্ষণ এবং তা বজায় রাখতে ব্যবহার করা যেতে পারে । এমপিএগুলি দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের পদ্ধতি তৈরি করে এবং ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । তবে, জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষাস্তর অনেক পরিবর্তিত হয় এবং সংরক্ষিত এলাকাগুলি শুধুমাত্র কোনও দেশের এক্তিয়ারের বাইরের এলাকার একটি ছোট অংশকে কভার করে । এলাকা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা সরঞ্জামগুলিকে স্বল্পমেয়াদী এবং জরুরি ব্যবস্থার জন্য ও একটি নির্দিষ্ট সেক্টরকে মোকাবিলা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ।
ইআইএ কী ?
পরিবেশের প্রভাব মূল্যায়নে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে এমন মানব কার্যকলাপের পূর্বাভাস দেওয়া, তা কমানো এবং প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা রয়েছে । যদিও ইআইএ-এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনি কাঠামো কোনও দেশের এক্তিয়ারের মধ্যে থাকা অঞ্চলগুলিতে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত ৷ এর বাইরের অঞ্চলগুলিতে এটি কম উন্নত । যখন একটি পরিকল্পিত কার্যকলাপ সামুদ্রিক পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে বা যখন এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে, তখন চুক্তির অধীনে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলি ইআইএ পরিচালনা করতে বাধ্য । এই ধরনের ক্ষেত্রে, এক্তিয়ার বা কার্যকলাপের উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকারী পক্ষকে মূল্যায়ন পরিচালনা করতে হবে ।
সিবি অ্যান্ড টিএমটি ?
সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সামুদ্রিক প্রযুক্তি হস্তান্তর আন্তর্জাতিক জলসীমায় পরিচালিত গবেষণায় ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার ও চুক্তিতে বর্ণিত ক্রিয়াকলাপে সহযোগিতা ও অংশগ্রহণকে সক্ষম করে । বিভিন্ন ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন তথ্য এবং গবেষণার ফলাফল শেয়ার করা; মানোন্নয়ন ও ম্যানুয়াল শেয়ার, নির্দেশিকা এবং মান; সামুদ্রিক বিজ্ঞানে সাহায্য ও সহযোগিতা; প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা এবং জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বা প্রক্রিয়া বিকাশ ও শক্তিশালী করা ।
প্রযুক্তি বাস্তবায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, চুক্তির প্রয়োগের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরকে অপরিহার্য করে তোলে । চুক্তি বাস্তবায়নে উন্নয়নশীল এবং ভৌগোলিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত রাজ্যগুলিকে সমর্থন করাই মূল ফোকাস ।
রাষ্ট্রসংঘের উচ্চ সমুদ্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ভারত কীভাবে লাভবান হতে পারে ?
বিবিএনজে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য এই বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদন দেয় ৷ পরে ভূ বিজ্ঞান মন্ত্রকের সচিব এম রবিচন্দ্রন জানিয়েছিলেন যে এটি ভারতকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের বাইরের অঞ্চলে, তার কৌশলগত উপস্থিতি বাড়ানোর অনুমতি দেবে ।
রবিচন্দ্রন বলেন, "আর্থিক সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি, এটি আমাদের সামুদ্রিক সংরক্ষণ প্রচেষ্টা ও সহযোগিতাকে আরও জোরদার করবে ৷ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য নতুন পথ উন্মুক্ত করবে ৷ আরও নমুনা পাওয়া যাবে ৷ সিকোয়েন্স এবং তথ্যের ব্যবহার, ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর ইত্যাদি, শুধু আমাদের জন্য নয় সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে আসবে ৷"
তিনি আরও যোগ করেছেন যে ভারত বিবিএনজে চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে "আমাদের মহাসাগরগুলি সুস্থ এবং স্থিতিস্থাপক থাকা নিশ্চিত করার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ" ।