বেঙ্গালুরু, 25 নভেম্বর: মহাকাশে যখন মহাকাশচারীরা থাকেন, তখন তাঁদের দীর্ঘ সময় ধরে ডিহাইড্রেট খাবার খেতে হয় ৷ এর জেরে মহাকাশচারীদের হাড়ের ক্ষয় হয় ৷ এর কারণ মাত্রাতিরিক্ত ক্যালসিয়াম নিঃসরণ ৷ এছাড়াও অ্যাসিডিক প্রস্রাবও হয় তাঁদের ৷ এছাড়া প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে মহাকাশচারীরা আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়েন ৷ অথবা তাঁদের কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় । তাই মহাকাশে কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার আণবিক প্রক্রিয়াগুলি বোঝার প্রয়োজন রয়েছে এবং এক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানোর জন্য আরও ভালো চিকিৎসা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ।
এই বিষয়টি বোঝার জন্য ধারওয়াদের ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার সায়েন্সেস (ইউএএস) এবং কেরালার ত্রিবান্দামের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআইএসটি) ফ্রুটস ফ্লাই বা ফলের মাছিগুলিকে নিয়ে একটি জৈবিক পরীক্ষার পরিকল্পনা করেছে ৷ এই মাছিকে ইসরোর গগনযান মিশনের অংশ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে ৷ পরের বছরের শেষে গগনযান মিশন হতে চলেছে ৷
এই মাছির বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘ড্রোসোফিলা মেলানোগাস্টার’ ৷ এটা সাধারণত কলায় পাওয়া যায় । গগনযান মিশনের একটি পেলোড মহাকাশে কিডনিতে স্টোন তৈরি হওয়া নিয়ে গবেষণা করবে ৷ যার নাম ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং কিডনি স্টোন ফরমেশন ইন স্পেস ইউজিং ফ্রুট ফ্লাইস: রেলেভেন্স টু অ্যাস্ট্রোনট হেলথ’ ৷ যার অর্থ - মহাকাশচারীদের স্বাস্থ্যের কারণে ফ্রুট ফ্লাই ব্যবহার করে মহাকাশে কিডনি স্টোন গঠনের প্রক্রিয়া বোঝা হবে ৷ এই গবেষণা খাদ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষার পথ খোলার অগ্রদূত হতে পারে মহাকাশে মহাকাশচারীদের জন্য ৷ এটি মহাকাশে মহাকাশচারীদের হাড়ের ক্ষয় এবং কিডনিতে পাথরের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানও খুঁজে বের করবে ৷
গবেষণা প্রকল্পটি আইআইএসটি-ত্রিবান্দ্রম এবং ইউএএস-ধারওয়াদের সহযোগিতায় সম্পাদিত হচ্ছে, যেখানে এই ফলের মাছিগুলি গগনযান মিশনে মহাকাশে পাঠানো হবে । এই উদ্দেশ্যে, আইআইএসটি 20টি ফলের মাছি (পুরুষ ও মহিলা সমান সংখ্যক) দিয়ে তৈরি একটি কিট ডিজাইন করেছে । কিটটি এক বছরের প্রচেষ্টায় প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এর সমস্তটি আইআইএসটি দ্বারা ডিজাইন ও ডেভেলপ করা হয়েছে । মোট প্রকল্পের খরচ 78 লক্ষ টাকা এবং ইসরো এতে সাহায্য করছে ৷
রবিকুমার হোসামানি, ক্যালিফোর্নিয়ার নাসা আমেস রিসার্চ সেন্টারের প্রাক্তন গবেষক এবং ধারওয়াদ ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার সায়েন্স (ইউএএস)-এর বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, এই গবেষণা অধ্যয়ন প্রকল্পে যৌথভাবে আইআইএসটি-এর সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন । তিনি ও তাঁর টিম এই উদ্ভাবনী মডেলের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন ।
এক সাক্ষাৎকারে রবিকুমার হোসামানি এই প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কথা বলেছেন ৷ তিনি জানিয়েছেন যে মাছিগুলি বংশবৃদ্ধি করবে এবং সেগুলিকে মূলত সোডিয়াম অক্সালেটের সঙ্গে মিশ্রিত সুজি ও গুড়ের মিশ্রণ দেওয়া হবে খাবার হিসেবে ৷ এই খাবার পাথর তৈরির ডায়েটযুক্ত রাসায়নিক ।
এই প্রোগ্রামের উপকারিতা সম্পর্কে কথা বলার সময় তিনি বলেন, "এই গবেষণাটি মহাকাশচারীদের মধ্যে কিডনিতে পাথর গঠনের মধ্যে পার্থক্য জানতে উপকারী হবে । আরও কয়েকটি পর্যায় পরে এটি এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য পালটা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে । ইঁদুরের মডেল এবং ড্রাগ আবিষ্কারের গবেষণায় প্রয়োগ করা হবে এই মডেল ৷ তাছাড়াই এই মডেল সিস্টেমটি সহজ জীব এবং দ্রুত প্রজনন-সহ বিভিন্ন রোগ বুঝতে সাহায্য করবে ।’’
হোসামনি পিএইচডি করেন মহীশূরের সিএফটিআরআই থেকে এবং প্রায় সাত বছর ধরে ক্যালিফোর্নিয়ায় নাসা আমেস রিসার্চ সেন্টারের জন্য কাজ করেছেন । তিনি নিয়মিতভাবে নাসার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন । পরে তিনি নাসা সেন্টারের রিসার্চ ফ্যাকাল্টি হন ।
তিনি জানান যে তাঁর ল্যাব এই ফলের মাছিগুলিকে আইএসএস-এ পাঠানোর জন্য বিশেষ এবং চারটি ফ্লাইট পরীক্ষা চালিয়েছে । এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি ও তাঁর গবেষণা দল মহাকাশে মহাকাশচারীদের বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া এবং অসুবিধাগুলি বোঝার চেষ্টা করেছিলেন ৷ তার মধ্যে ছিল - কম মাধ্যাকর্ষণ পরিবেশে মস্তিষ্ক কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার সময় কীভাবে হার্টের কার্যকারিতা এবং গঠন পরিবর্তন হয় ইত্যাদি ।
2017 সালে রবিকুমার ইউএএস ধারওয়াদে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন । যখন ভারত সরকার গগনযান মিশনের জন্য প্রস্তাবের জন্য আহ্বান জানায়, আইআইএসটি এবং ইউএএস-ধারওয়াদ ফ্রুট ফ্লাই প্রজেক্ট নিয়ে ইসরোর সঙ্গে যোগাযোগ করে ।
গগনযান প্রকল্পের জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে রবিকুমার বলেন, "স্পেস বায়োলজি (মহাকাশ জীববিজ্ঞান) ভারতে একটি নতুন ঘটনা এবং গবেষণার এই ক্ষেত্রে খুব কমই মানুষ কাজ করছেন ৷ ইসরো এখন এটিকে সাহায্য করছে ৷ তবে, নাসা এবং ইউরোপীয় দেশগুলির মতো পশ্চিমী বিশ্বে এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষণা ক্ষেত্র ৷ এই প্রকল্পটি এই ধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথম উদাহরণ এবং ভারতে গবেষণার বিশেষ অঞ্চল তৈরি করবে ৷"
হোসামনি গগনযান কর্মসূচির অংশ হতে যাওয়া ফলের মাছি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবেও বলেন ৷ তিনি জানান যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অভাবে হাড় ও পেশির ক্ষয়ক্ষতি হবে এবং ক্যালসিয়ামও বেরিয়ে যাবে, যা কিডনিতে জমা হয় এবং অবশেষে পাথর তৈরি করে । সুতরাং, মহাকাশে থাকাকালীন মহাকাশচারীদের কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি ৷ এই গবেষণা প্রকল্পে মহাকাশে কিডনিতে পাথরের গঠন কীভাবে পৃথিবী থেকে আলাদা, তা নিয়েও গবেষণা করা হবে ।
এই প্রকল্পের জন্য কেন ফলের মাছিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ফলের মাছি তাদের শারীরিক গঠনের জন্য পরিচিত, যা মানুষের মতোই । শূন্য অভিকর্ষের অধীনে এই মাছিগুলির মধ্যে যে পরিবর্তনগুলি ঘটে, তা ভবিষ্যতের মনুষ্যবাহী মহাকাশ মিশনের জন্য মূল্যবান তথ্য দেবে বলে আশা করা হচ্ছে । মানুষের রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত 77 শতাংশ জিন হোমোলজি, একটি সংক্ষিপ্ত জীবনচক্র এবং কম খরচ, ড্রোসোফিলা মেলানোগাস্টার উল্লেখযোগ্য সুবিধা প্রদান করে ।
তিনি আরও জানান, ফলের মাছির অঙ্গ অর্থাৎ ম্যালপিঘিয়ান টিউবুলস জিনগত গঠন, কার্যকারিতা এবং তা গঠনে মানব কিডনির গঠনের কাছাকাছি ৷ এটা কিডনি পাথর গঠন অধ্যয়ন এবং পরিমাপ করার জন্য একটি চমৎকার মডেল তৈরি করে । তাই, ড্রোসোফিলা মেলানোগাস্টার স্বল্পমেয়াদী স্পেসফ্লাইট অবস্থার অধীনে কিডনি স্টোন প্যাথলজি তদন্ত করতে ব্যবহার করা হয় ৷
ড. হোসামনি আরও জানান যে গগনযান মহাকাশ যানটি পৃথিবীর উচ্চতা থেকে প্রায় 400 কিলোমিটার কম পৃথিবীর কক্ষপথে শূন্য মাধ্যাকর্ষণে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে । এটা ফিরে আসার আগে তিন থেকে পাঁচ দিন পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গুজরাতের উপকূলে ফিরে আসবে । পরে বিজ্ঞানীরা এই সময়ের মধ্যে নমুনা কিটের পরিবর্তনগুলি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন ।
ইউএএস-ধারওয়াদের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক পিএল পাটিল বলেন, ‘‘ফলের মাছির শিশি-সহ মহাকাশে ড্রোসোফিলা পরীক্ষা চালানোর জন্য বিশেষ হার্ডওয়্যার তৈরি করা হবে । পৃথিবীতে ফিরে আসার পর, আমরা আইআইএসটি টিমের সঙ্গে সহযোগিতায় আরও বিশ্লেষণের জন্য মাছি-কাঠামোর ম্যালপিঘিয়ান টিউবুলগুলিকে বিচ্ছিন্ন করব, যা মানুষের কিডনির মতো ।’’