যৌন সম্পর্কের মানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই বদলে গিয়েছে । যৌন সম্পর্ককে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, তা জানার আগে এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ যে আজকের দিনে মানুষ কী ধরনের যৌন সম্পর্ক উপভোগ করতে চান । বর্তমান সময়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় । প্রথমটি হল স্থায়ী সম্পর্ক বা যে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়। এরপর আসে কম সময়ের বা অস্থায়ী সম্পর্কের বিষয় । এর মধ্যে রয়েছে হঠাৎ করে সম্পর্ক তৈরি হওয়া, ডেটিং-এর মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি হওয়া, কেউ কাউকে না চিনেই এমনিই শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করা ইত্যাদি । এই সব ক্ষেত্রগুলিতে শারীরিক চাহিদাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় । আর শেষেরটি হল যৌন পেশা। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক তৈরি করা ।
এই বিষয়ে ইটিভি ভারত-এর সুখীভব টিম কথা বলেছিল ড. বীণা কৃষ্ণানের সঙ্গে । তিনি একজন অভিজ্ঞ মনরোগ বিশেষজ্ঞ । তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনও ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই দু’জন মানুষের মধ্যে আবেগময় সংযোগ তৈরি হয় না । আমেরিকান সোশিওলজিক্যাল রিভিউ নামে একটি সংস্থা একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে । সেই সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কে থাকেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যে আরও বেশি করে আবেগময় ভাবে সংযুক্ত হতে পারে এবং সম্পর্ককে আরও সুরক্ষিত বলে মনে করেন । বিশেষ করে মহিলারা আনন্দ, সন্তুষ্টি এবং উত্তেজনা অনুভব করেন যৌন সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সময় ।
একই বিষয় নিয়ে 2015 সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল । গবেষণার বিষয় ছিল সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক । তাতে দেখা যায়, মহিলাদের স্বল্প মেয়াদের সম্পর্ক বা হঠাৎ হওয়া ইচ্ছে থেকে তৈরি হওয়া যৌন সম্পর্কের তুলনায়, স্থায়ী সম্পর্কে যৌন মিলনের সময় সঠিক ভাবে অর্গাজম হয় । তবে মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা আবেগময় সম্পর্ক তৈরি করার চেয়ে ঘনিষ্ঠতা তৈরি এবং তাৎক্ষণিক সুখ পেতে অনেক বেশি পছন্দ করেন । সেই কারণেই পুরুষরা আচমকা কোনও সম্পর্ক তৈরি করতে এবং সেই সম্পর্ককে যৌন মিলন পর্যন্ত নিয়ে যেতে বেশি পছন্দ করেন ।
ভালো যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগময় ঘনিষ্ঠতা জরুরি
‘ইন্টিগ্রেটিভ সেক্সুয়াল হেলথ’ নামে প্রকাশিত হওয়া একটি বইয়ের সহ লেখক ড.বার্টলিক জানান, টিভি বা সিনেমায় যে ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয় বাস্তব পরিস্থিতি তার থেকে একেবারে আলাদা । একজন অপরিচিতর সঙ্গে প্রথমবার দেখা হল । আর তাঁর সঙ্গে আনন্দ ও সন্তোষজনক যৌন মিলনও হল কোনওরকম যথাযথ যোগাযোগ তৈরি হওয়ার আগেই । এটা পুরোটাই কাল্পনিক । রিল লাইফের থেকে যদি রিয়েল লাইফে আসা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে ভালো ও সন্তোষজনক শারীরিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে যুগলের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই জরুরি । এটা তখনই সম্ভব, যখন দু’জনের মধ্যে পছন্দ, অপছন্দ বা কল্পনা নিয়ে কোনওরকম ইতস্ততভাব ছাড়া খোলাখুলি আলোচনা সম্ভব হয় ।
বার্টিকের মতে, যৌন সম্পর্ক তৈরি করার জন্য পুরুষ ও মহিলাদের চিন্তাভাবনা মারাত্মকভাবে পরিবর্তিত হয় । একদিকে মহিলারা অনুভূতি ও ভালোবাসার দ্বারা সক্রিয় হয়ে ওঠে, আর অন্যদিকে পুরুষদের কাছে যৌন সম্পর্কের মানে হল আবেগময় ঘনিষ্ঠতা । এই আলাদা চিন্তাভাবনা যাতে সম্পর্কের উপর কোনও প্রভাব না ফেলে, তার জন্য যুগলদের একে অপরের ইচ্ছাকে সম্মান দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পর্ককে উপভোগ্য করে তোলার জন্য সম্প্রীতি বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে ।
তবে এছাড়া এই বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ 2014 সালে প্রকাশিত করে ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড হেল্থ সাইকোলজি'। তাতে উল্লেখ করা হয়, যদি যুগলের মধ্যে বিশ্বাস ও আবেগময় সংযোগ থাকে, তাহলে পুরুষ ও নারী উভয়েই একে অপরের যৌন চাহিদা এবং কল্পনা পূরণ করার চেষ্টা করে । এই ধরনের প্রচেষ্টা যদি কোনও একজন জোর না করে, লজ্জা না পেয়ে বা ইতস্তত না করে করতে পারে, তাহলে যৌন সম্পর্ক তাদের মধ্যে অনেক বেশি আনন্দের হয় ।
যৌন সম্পর্কে সন্তুষ্টিকে কীভাবে আরও বেশি করা যায় ?
- লাউরি এ ব্রোটো, দ্য ওমেন সেক্সুয়াল হেলথ কানাডা রিসার্চের চেয়ারপার্সন এবং ভাঙ্কুভারের ব্রিটিশ কলম্বিয়া ওমেন’স হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এই বিষয়ে গবেষণা করেন । সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যৌন মিলনের সময় নিজের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে মহিলারা প্রশিক্ষণ নেন, তাঁরা অবসাদ ও চাপ থেকে তৈরি হওয়া সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারেন এবং তাঁদের যৌন সম্পর্কও অনেক ভালো হয় ।
- অনেক মানুষ বিশেষ করে মহিলারা তাঁদের যৌন চাহিদা এবং অনুভূতি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে ইতস্তত বোধ করেন । অথবা কিছু মানসিক সমস্যা যৌন মিলনের সময় মনসংযোগ করতে বাধা দেয় । ফলে যৌন সম্পর্কের উপর প্রভাব পড়ে । তাই যৌন মিলনের সময়ে অন্য কিছু চিন্তা না করে, ওই বিষয়ে মনসংযোগ করা উচিত এবং সন্তোষজনক যৌন মিলনের জন্য যৌন সম্পর্কের সময় সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিত ।
- ড. মাইকেল ক্রিচম্যান, নিউপোর্ট সৈকতে অবস্থিত সাউর্দান ক্যালিফোর্নিয়া সেন্টার ফর সেক্সুয়াল হেলথ-এর এমডি । তাঁর মতে, ব্যক্তিগত স্তরে অনুভূতি, ইচ্ছা ও শারীরিক চাহিদা নিয়ে বোঝাপড়া এবং সৎ থাকা ভালো সম্পর্কের জন্য খুবই জরুরি ।
- কখনও কখনও শারীরিক সম্পর্কের সময় মানুষ অনেক বেশি সতর্ক, সাবধানী এবং শারীরিক ওজন, শারীরিক গঠন ও যৌনাঙ্গের আকার নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন, যা দু’জনের মধ্যে সম্পর্কে মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলে । ড. মাইকেল ক্রিচম্যান ব্যাখা করে বুঝেয়েছেন, যদি কোনও মহিলা বা পুরুষ এই ধরনের চিন্তাভাবনা করতে থাকেন, তাহলে তাঁদের যৌনজীবনের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে । এধরনের ক্ষেত্রগুলিতে তাঁদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে অনুভূতি এবং শরীরে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ছোঁয়া অনুভব করতে হবে
- মিসিয়াগুয়ার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগে কর্মরত ড.আনা এম লোমানোস্কা জানান, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা খুবই জরুরি । এমনকী, যখন তিনি দূরে থাকেন, তখনও । তাহলে কেউই একে অপরের থেকে নিজেকে বিচ্ছন্ন মনে করবেন না । এর ফলে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাবে এবং দু’জনের মধ্যে ভালোবাসাও বৃদ্ধি পাবে । যুগলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে পারেন । এর মধ্যে রয়েছে টেক্সট মেসেজ, ভিডিও কল, চ্যাট ইত্যাদি ।
আরও পডু়ন : ডিম্বাণু সংরক্ষণ তথা এগ ফ্রিজিং সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার নিরসন
পারস্পরিক বোঝাপড়া, কল্পনা ও যৌন চাহিদা পূরণ করা নিয়ে একে অপরকে সাহায্য করা এবং কোনও রকম ইতস্তত বোধ ছাড়া একে অপরের সঙ্গে কথা বলাকে যুগলের মধ্যে সুস্থ ও সন্তোষজনক যৌন সম্পর্ক হিসেবে ধরা যেতে পারে ।