তমলুক, 6 অক্টোবর : রাবণ বধের জন্য অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেছিলেন রামচন্দ্র । ভক্তের পরীক্ষা নিতে দেবীই সরিয়ে দিয়েছিলেন একটি ফুল । ফলে পদ্মের অভাবে বন্ধ হতে বসেছিল পুজো । আর তখনই দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজের পদ্মসম চোখ অর্পণ করতে যান রামচন্দ্র । ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে দশভূজা রূপে আবির্ভূত হয়ে দেবী ফিরিয়ে দেন লুকিয়ে রাখা পদ্ম । সেই থেকেই উমার আরাধনায় লাগে 108 টি পদ্ম । আর তাই প্রতিবছরই দুর্গাপুজোর সময় পদ্ম ফুলের চাহিদা থাকে তুঙ্গে । রাজ্যের বাইরেও এইসময় ফুলের জোগান দিয়ে থাকে পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া,পশ্চিম মেদিনীপুরসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি । কিন্তু কোরোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক পুজো উদ্যোক্তাই এবছর তাদের পুজো বন্ধ রেখেছে । আর তাই বরাত মিলছে না পদ্মের । বাজারে চাহিদাও নেই ফুলের । ফলে চাষের পিছনে খরচ করেও ফুলের দাম না পাওয়ায় ব্যাপক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পদ্ম চাষিরা । চাষিদের আর্থিক ক্ষতির কথা মাথায় রেখে রাজ্যের হর্টিকালচার বিভাগের মন্ত্রী আবদুর রেজ্জাক মোল্লার দ্বারস্থ হতে চলেছে সারা বাংলা ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতি ।
এরাজ্যসহ গোটা দেশ ও বিদেশে প্রতিবছর পুজোর সময় প্রায় 20 লাখ পদ্মের চাহিদা তৈরি হয় । যার সিংহভাগের জোগান দেয় পূর্ব মেদিনীপুর জেলা । যে কারণে প্রতিবছর পাঁশকুড়া, কোলাঘাট, তমলুক, মহিষাদল, রামনগরসহ একাধিক ব্লকের রেল ও সরকারি জলাশয়গুলি লিজ নিয়ে পদ্ম চাষ করেন চাষিরা । ডিসেম্বর মাস থেকেই চারা (গেঁড়) লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় । গাছে ফুল আসতে শুরু করে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে । জুলাই মাস থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পুজোর জন্য বাজারে চাহিদা শুরু হয় পদ্মের । দুর্গাপুজো উপলক্ষে সেপ্টেম্বর থেকেই কোল্ডস্টোরগুলিতে ফুলের সংরক্ষণ শুরু করেন চাষিরা । কিন্তু এবছরের ছবিটা সম্পূর্ণ উলটো । কোরোনা সংক্রমণের কারণে বিশ্বকর্মা পুজোর সময় হিমঘরে মজুত রেখেও বাজারে চাহিদা না থাকায় ফেলে দিতে হয়েছে বহু ফুল । ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে বহু চাষিকে ।
প্রতিবছর বেঙ্গালুরু, দিল্লি, গুজরাত, বিহার ও ওড়িশা থেকে ফুল ব্যবসায়ীরা পুজোর এক মাস আগে থেকেই ফুলের বরাত দেন ৷ কিন্তু এবছর তাঁরাও মুখ ফিরিয়েছেন । অন্যান্য বছর এই মরশুমে ফুল বিক্রি হত 10 থেকে 12 টাকা দামে ৷ সেই ফুলই এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে পিস প্রতি 2 থেকে 3 টাকায় । চাষিরা জানিয়েছেন, এক বিঘা জলাশয় লিজ নিয়ে পদ্ম চাষ করতে খরচ পড়ে 30 হাজার টাকা মতো । ভালো দাম পাওয়া গেলে লাভ থাকে কুড়ি হাজার টাকার মতো । কিন্তু এবছর যে মূল্যে ফুল বিক্রি হচ্ছে তাতে আসল টাকা উঠে আসবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে । বাজারে চাহিদা না থাকায় চাষিরা সেভাবে হিমঘরে মজুত করেননি ফুল । তাই পুজোর একদম প্রাক্কালে ফুলের চাহিদা তৈরি হলেও জোগান দেওয়া সম্ভব হবে কি না তাও সুনিশ্চিত নয় । এইসব সমস্যা নিয়েই চলছেন জেলার প্রায় হাজার দু'য়েক পদ্ম চাষি ।
প্রায় আট বিঘা জলাশয়ে পদ্মের চাষ করেছেন সুনীল মাইতি । তিনি বলেছেন, "প্রতিবছর যে সকল পুজো উদ্যোক্তা আমাদের ফুলের বরাত দেন তাঁরাও এবছর কেউ আসেননি । ট্রেন না চলায় বাইরের রাজ্য ফুল পাঠানো যায়নি । বাগানের পরিচর্যা করে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে । ফুলের দাম না থাকায় টাকা উঠে আসবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি ।" আরও এক পদ্ম চাষি প্রসেনজিৎ কর জানিয়েছেন, "প্রতিবছর এ সময় পদ্মের দাম ওঠে প্রায় 10 থেকে 15 টাকা পর্যন্ত । কিন্তু এ বছর সেই ফুল বিক্রি হচ্ছে 2 থেকে 3 টাকায় । 500 পিস ফুল নিয়ে এখন বাজারে গেলে প্রথমদিকে 2 থেকে 3 টাকায় বিক্রি হচ্ছে ৷ শেষের দিকে এক টাকা দরে ফুল বিক্রি করতে হচ্ছে । অনেক সময় আমরা ফুল ফেলে দিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছি । ওষুধ, সার, মজুরির পিছনে টাকা খরচ করেও ফুলের দাম না পাওয়ায় এখন আমরা কঠিন সমস্যার মধ্যে রয়েছি ।"