মালদা, 23 অগস্ট: প্রবাদ রয়েছে, নদীর তীরে বাস, ভাবনা বারোমাস ৷ এই প্রবাদ কতটা ভয়ঙ্কর বাস্তব হতে পারে, তিন দশক ধরে এই জেলায় তার প্রমাণ দিচ্ছে গঙ্গা ৷ যে নদীতে যেতে একসময় গাড়ি চাপতে হত, সেই নদী এখন বাড়ির নীচে ৷ কখন গঙ্গা বাড়ি তার কোলে টেনে নেবে, কেউ জানে না ৷ হাতে আর সময় তেমন নেই ৷ তাই দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে গড়া মাথার ছাদ নিজেরাই ভেঙে দিচ্ছে রতুয়া-1 নম্বর ব্লকের মহানন্দটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের কান্তটোলার বাসিন্দারা ৷ ইতিমধ্যে একশোর বেশি পরিবার নিজেদের বাড়ি ভেঙে ফেলেছেন ৷ বাকিরাও সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন ৷ সবার ক্ষোভ প্রশাসন আর এলাকার জনপ্রতিনিধিদের উপর ৷
রতুয়া-1 নম্বর ব্লকের মহানন্দটোলা ও বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভৌগলিক অবস্থানই দুই এলাকার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে ৷ এই দুই পঞ্চায়েত এলাকার একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে ফুলহর ৷ একদিকে বইছে কোশি নদীও ৷ বেশ কয়েক বছর ধরে তিন নদীই পাড়ে ছোবল মারছে ৷ কিন্তু গঙ্গার ভাঙন কাহিনি আলাদা ৷ তিন দশক আগে কান্তটোলা থেকে অন্তত 32 কিলোমিটার দূর দিয়ে বইত গঙ্গা ৷ গঙ্গাস্নান করতে গ্রামবাসীদের গাড়ি চেপে নদী যেতে হত ৷ কিন্তু এখন গোটা গ্রাম গিলতে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে সে ৷ নদীর স্রোতের থেকেও অনেক বেশি গতিতে এলাকায় ছুটছে আতঙ্কের স্রোত ৷
আরও পড়ুন: মুখ ফিরিয়েছে প্রশাসন, ভাঙন থেকে বাঁচতে গঙ্গাপুজো দুর্গত মহিলাদের
দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে চোখের জল আটকাতে পারেননি কান্তটোলার মুনিয়া মণ্ডল ৷ বলেন, "কত দূরে নদী ছিল ৷ পাড় ভাঙতে ভাঙতে ঘরের নীচে চলে এল ৷ নিজের হাতে বাড়ি ভেঙে ফেললাম ৷ আমাদের বাঁচাতে কোনও নেতা কাজ করে না ৷ শুধু দেখতে আসে আর চলে যায় ৷ বলেছিল, এবার গঙ্গা বেঁধে দেবে৷ বাঁধেনি ৷ বাড়ি ভেঙে গ্রামের অনেক মানুষ রাস্তার ধারে ইট ফেলে রেখেছে ৷ সবাই একটা করে ঘর রেখেছে ৷ সেই ঘরেই সবাই থাকছে ৷ অন্তত 100 বাড়ি ভাঙা হয়েছে ৷ নদীর জল বাড়বে ৷ সব ঘরে জল ঢুকবে ৷ ভাঙন বাড়বে ৷ বাড়ি নদীতে চলে যাবে ৷ তখন কী হবে ! বাচ্চা নিয়ে রাত জেগে ঘরে বসে থাকছি ৷ আতঙ্কে ঘুম হয় না ৷ এটা বড় গঙ্গা ৷ একে বিশ্বাস নেই ৷"
নদীর গতি প্রকৃতি দেখে কাঁচা পাটই জমি থেকে কেটে নিচ্ছিলেন অনিতা মণ্ডল ৷ তিনি বলেন, "পঞ্চায়েত থেকে আমাদের শুধু একটা ত্রিপল দিয়েছে ৷ চাল বা অন্য কিছু দেয়নি ৷ ঘরে কাঁথা, মশারিও নেই ৷ নিজের ঘর নিজে ভেঙে ফেলেছি ৷ লোকের বাড়িতে ইট ফেলতে গিয়ে ঘাড়ধাক্কা খেয়েছি ৷ আমরা কোথায় যাব? আমাদের ব্যবস্থা করে দাও ৷ গঙ্গার ব্যবস্থা করে দাও ৷ নেতাদের সব জানিয়েছি ৷ মুখোপাধ্যায় (স্থানীয় বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায়) বলছে, ওঁর বাবা, মা, এমনকী ওঁরও এখানে জন্ম ৷ ওঁর কিছু করার নেই ৷ একথা বলে ভোটে দাঁড়াচ্ছে ৷ সবার ভোট পেয়ে জিতে যাচ্ছে ৷ তারপর আর খোঁজ নেই ৷ আমরা চাই, নদী বাঁধা হোক ৷ আমাদের প্রত্যেককে খাসের দু'কাঠা করে জমি দেওয়া হোক ৷ তোমাদের হাতে লোক আছে ৷ তোমরাই তো ভগবান ৷"
আরও পড়ুন: একে গঙ্গায় রক্ষা নেই, দোসর কোশি ; দুই নদীর ভাঙনে বিপন্ন লাখ তিনেক মানুষ
গ্রামের চৈতন্য মণ্ডল জানান, নদী পাড় কাটতে কাটতে পাশে চলে এসেছে ৷ ভয়ে বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছে ৷ মাত্র একটা করে ঘর রাখা হয়েছে ৷ তিনি দাবি করেন, কেন্দ্র কিংবা রাজ্য, কোনও সরকারই সাহায্য করনি ৷ যা জমি জায়গা ছিল, সব গঙ্গার কবলে চলে গিয়েছে ৷