কলকাতা, 28 সেপ্টেম্বর : পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের শুরু । শিউলির গন্ধে ভরা শরতের অমাবস্যার ভোর আজও যার দেবী বন্দনায় মুখরিত ৷ আজও মহালয়ার ভোরে যার মহিষাসুরমর্দিনী না শুনলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় আপামর বাঙালির শারদোৎসব ৷ তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ৷ পেরিয়েছে অনেক বছর ৷ রেডিয়োয় মহালয়া শোনার সেই নেশাও ধীরে ধীরে হারিয়েছে ৷ তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সেই মহালয়া পাঠেও এক সময় সংকীর্ণ রাজনীতি থাবা বসিয়েছিল ৷ আচমকাই 1976 সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ করানো হয় ৷ কিন্তু তা মানতে পারেনি বাঙালি ৷ বিক্ষোভ দেখানো হয় আকাশবাণী ভবনের সামনে ৷ ষষ্ঠীর দিন ফের সম্প্রচার করতে হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী । তবে এখানেই শেষ নয় ৷ পরে বীরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন মহানায়ক ৷ ক্ষমাও চান তিনি ৷ কী হয়েছিল সেদিন? তৎকালীন সময়ের নানা কথা উঠে এল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উত্তরসূরির স্মৃতিচারণে ৷
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উত্তরসূরিরা সকলেই এখন বিদেশে ৷ যাঁরা কলকাতায় আছেন তাঁরাও এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে । আজও উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরের টাউন স্কুল সংলগ্ন সাত নম্বর রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জ্ঞাতি,শরিকি সকলে রয়েছেন । তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঘরেই এখনও থাকেন মেয়ে সুজাতা ভদ্র ৷ 86 বছর বয়সে এসে স্মৃতিতে মরচে ধরেনি ৷ বলেন, "উত্তমকুমার মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ করার পর তিনদিন আমরা বাড়িতে থাকতে পারিনি । বাড়ির সামনে হাজার হাজার লোক । ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন তাঁরা ৷ গোলমাল হয়েছে । রাস্তায় নো এন্ট্রি বোর্ড লাগানো রয়েছে । উত্তমকুমার বাবাকে বলেছিলেন, তিনি মহিষাসুরমর্দিনী করতে চাননি । তাঁকে জোর করে করানো হয়েছিল ।"
সত্যিই এক বিরল কণ্ঠ ৷ এই কণ্ঠ বাঙালির ঘরে আর ফেরেনি ৷ মহালয়া এবং মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে অনেকে অনেক গবেষণা করেছেন । কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বিকল্প আজও পাওয়া যায়নি ৷ মেয়ে সুজাতার বক্তব্য, "সেবার উত্তমকুমার মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ করলেন । বাবা শুনে বলেছিলেন, লোকে নতুন কিছু চায় । উত্তমকুমারের মহালয়া মানুষ শুনবে । নতুনত্ব সবাই চায় । কিন্তু আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ উত্তমকুমারকে দিয়ে মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ করিয়ে সফল হয়নি । বাধ্য হয়ে ফের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী বাজাতে হয়েছিল রেডিয়োতে । লাইভ অনুষ্ঠানের সময় অন্ধকার ছাদে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে সবাই আকাশবাণী কলকাতার মহিষাসুরমর্দিনী শুনতেন৷"
সুজাতার স্মৃতিচারণে উঠে এল আকাশবাণীতে মহালয়া পাঠ করতে যাওয়ার দিনগুলি ৷ বললেন, "রাত দুটোর সময় আকাশবাণী ভবন থেকে গাড়ি এসে বাবাকে নিয়ে যেত । যুদ্ধের পরে সরাসরি অনুষ্ঠান আর হয়নি ৷ তারপর থেকে মহিষাসুরমর্দিনীর রেকর্ড চালানো হত ৷ কিন্তু প্রতি মহালয়ার ভোরেই তিনি যেতেন আকাশবাণী ভবনে । কেউ কোনও ভুল-ত্রুটি করলে শুধরে দিতেন । বাবার দৈনন্দিন জীবন, স্মৃতি বিজড়িত বহু জিনিসের কথাও উঠে এল সুজাতার কথায় ৷ বললেন, "বাবা অল্প সময় বাড়িতে থাকতেন । যেটুকু সময় থাকতেন নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন । শেষের দিকে শরীর ভালো না থাকায় খুব একটা বের হতেন না । বাড়িতেই শুয়ে, বসে, পড়াশোনা করতেন ।"
তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অনেক বই, জিনিসপত্রের আজ কোনও হদিশ নেই ৷ এক সময় যাঁরা বাড়ি আসতেন কিছু জিনিস নিয়ে গেছেন ৷ আর ফেরত দেননি ৷ অনেকে অনেক কিছু করে নিয়েছেন । কিন্তু বাবা কিছুই করতে পারেননি । আক্ষেপ মেয়ের ৷ তবে এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি বাঙালিকে যা দিয়ে গেছেন তা কোনও দেওয়া-নেওয়ার মাপকাঠিতে মাপা যায় না ৷
আজ মহালয়া ৷ হয়তো আজও কোনও রেডিয়োকে ঘিরে চাদর মুড়ি দেয়ে সবাই শুনছেন মহিষাসুরমর্দিনী ৷ আবার শরতের আকাশ ভরে উঠেছে তাঁর কণ্ঠে -"আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর । ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা ।"