কলকাতা, 31মার্চ : এখানে সবকিছু বিক্রি হয়। সবকিছু বলতে সব কিছু। পুরোনো বেডপ্যান থেকে শুরু করে জামাকাপড়, বাচ্চাদের খেলনা, ফ্রাইং প্যান, দামি ঘড়ি, ঝাড়বাতি, পর্দা, আসবাবপত্র, পুরোনো বই, পুরোনো ক্যাসেট এবং আরও কত কি!
এটা কোনও বাজার নয়। জায়গাটা হল একটি নিলাম ঘর। আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরোনো নিলাম ঘর। রাসেল এক্সচেঞ্জ। যারা পুরোনো কলকাতার সঙ্গে পরিচিত তারা অনেকেই হয়ত রাসেল এক্সচেঞ্জ সম্বন্ধে বেশ ওয়াকিবহাল। কেউ হয়তো রাসেল স্ট্রিট দিয়ে যাতায়াতের পথে দেখেছেন দোকানটি। একসময়ের এই পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা স্বর্ণযুগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। যদিও এখন তা পড়ন্ত।
কবে শুরু হয় এই নিলাম ব্যবসা, কে শুরু করেন এই নিলাম ঘর এবং কারা আসতেন এখানে ? 1940 সালে আবদুল সমত এই নিলাম ঘর শুরু করেন। বর্তমানে দোকানটি চালান আবদুল সমতের দুই নাতি আনোয়ার সেলিম ও আরসদ সেলিম।
একসময় বিদেশি জিনিসপত্রের প্রতি মানুষের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর তাদের বাড়ির জিনিসপত্রও নিলামে উঠত। এছাড়াও বিভিন্ন দূতাবাসের কোনও বড়কর্তা বদলি হলে তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্রও নিলাম করা হত। কিন্তু এখন প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্র নিলামে ওঠে।
জিনিসপত্র কিনতে বা বিক্রি করতে বহু মানুষের সমাগম ছিল দোকানটিতে। অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন আসতেন মেয়ে মুনমুনকে নিয়ে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বহু লেখা ও চলচ্চিত্রে রাসেল এক্সচেঞ্জের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসেছেন জাভেদ আখতার ও শাবানা আজমি। একসময়ে ব্রিটিশরা আসতেন, আসতেন বহু রাজা, নামি চিত্রশিল্পী ও পরিচালক।
অনোয়ার সেলিম বলেন, "বেশ কিছু বছর নিলামের বাজার মন্দা থাকলেও আবার মানুষের মধ্যে এই ধরনের জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ছে। এখন অনেক অল্পবয়সী আসেন জিনিসপত্র কিনতে। ইন্দোনেশিয়ান বা অন্যান্য কম দামি আসবাব না কিনে তারা পুরনো আসবাবপত্র কিনতে বেশি উৎসাহী।
নোনা ধরা এই দেওয়ালগুলোতে কান পাতলে হয়ত এখনও ইতিহাসের ফিসফিসানি শোনা যাবে, শোনা যাবে কত গল্প। একবার নিলামে উঠেছিল প্রয়াত শিল্পী গণেশ পাইনের স্ত্রীর একটি দামি শাড়ি যা তিনি মাত্র একবার পরেছিলেন।"
আজ কলকাতার অনেকগুলি নিলাম ঘর বন্ধ হয়ে গেলেও টিকে আছে এই রাসেল স্ট্রিটের তিনটি নিলাম ঘর- দা রাসেল এক্সচেঞ্জে, দা সুমন এক্সচেঞ্জ ও দা মডার্ন এক্সচেঞ্জ। মডার্ন ও সুমন এক্সচেঞ্জ তৈরি হয় অনেক পরে। এখনও চিরাচরিত প্রথা মেনে নিয়মিত প্রতি বৃহস্পতিবার জামাকাপড় ও প্রতি রবিবার বাকি জিনিসপত্র নিলাম হয় রাসেল এক্সচেঞ্জে।
তবে এখন রবিবারের নিলামের সেই জৌলস যেমন হারিয়েছে তেমনই ক্রেতারাও নেহাত মামুলি। তবে নিলামের দিনে আজও রাসেল এক্সচেঞ্জে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। ঘরের মাঝামাঝি একটা লম্বাটে ধরনের কাঠের টেবিলের উপর ছোটোখাটো বিভিন্ন মালপত্র বোঝাই করা থাকে। এছাড়া সেদিনের নিলামে বাকি মালপত্র বিভিন্ন দিকে রাখা থাকে। কোনও ক্রেতার বিশেষ কোনও জিনিস পছন্দ হলে তিনি দর হাঁকেন। এভাবেই বেশি দর যিনি হাঁকেন তিনি সেটি কিনে নেন। বিক্রির টাকার 20 শতাংশ যায় নিলাম ঘরে।
একসময়কার নামজাদা সব নিলাম ঘর যেমন ম্যাকেঞ্জি ল্যাল অ্যান্ড কো, স্টেনার অ্যান্ড কো, ডালহৌসি এক্সচেঞ্জ, চৌরঙ্গি সেলস বুরো প্রাইভেট লিমিটেড, ভিক্টর ব্রাদার্স বা ডি আলবার্ট অ্যান্ড কো আরও কত নাম -- আজ সব ইতিহাস। এই দৌড়ে স্বমহিমায় আজও টিকে রয়েছে এই রাসেল এক্সচেঞ্জ।
তবে ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত অনোয়ার ও আরসদ সেলিম। তাই ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে দোকানের আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্রও সিনেমার শুটিং -এ ব্যবহার করার জন্য ভাড়া দিচ্ছেন তারা। কয়েক বছর আগে রাসেল এক্সচেঞ্জে একটি ফ্যাশন শো-র আয়োজন করা হয়। আনোয়ার সেলিম বলেন, "আগে আমরা শুধুই নিলামের কাজ করতাম এখন নিলামের পাশাপাশি রিটেলের দিকেও ঝুঁকেছি। নিলাম ছাড়াও এখানে এসে কেউ পছন্দ করে আসবাবপত্র কিনে নিয়ে যেতে পারেন।"
তিনি বলেন, "রাসেল এক্সচেঞ্জ যেমন আমাদের গর্ব ঠিক তেমনভাবে এই রাসেল এক্সচেঞ্জ কলকাতার ঐতিয্যের একটা বড় অঙ্গ , তাই এত সহজে আমরা হাল ছাড়ব না।"