কলকাতা, 15 সেপ্টেম্বর : শারদ সকালে ধ্বনিত হতে চলেছে আকাশবাণীর মহিষাসুরমর্দিনী । মহালয়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সানুনাসিক কন্ঠে মন্ত্র উচ্চারণের মাঝে আবির্ভাব হবেন জবাকুসুম । প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত হবে জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা । চিন্ময়ীদেবীর মৃন্ময়ীকে আবাহনের সূচনা লগ্নে আপামর সনাতন ধর্মের মানুষজন পূর্বপুরুষকে স্মরণ করবেন ভক্তি ভরে। তাঁদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করবেন তর্পণ। সেটাই তো চেনা ছবি। কিন্তু মহামারীর এই সময় বড় দুঃসময়। আর তাই নিয়ন্ত্রিত হতে চলেছে তর্পণ। এমন নিয়ন্ত্রণের পক্ষেই রয়েছে পুরোহিত সমাজ । সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের মত, শাস্ত্র মেনে এবার বাড়িতেই স্মরণ করা যেতে পারে পূর্বপুরুষদের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতও একই ।
তর্পণ কী ? কেন করতে হয় তর্পণ ?
তর্পণ শব্দটি এসেছে দেবনাগরী "ত্রুপ" থেকে । এই শব্দের অর্থ সন্তুষ্ট করা । সনাতন ধর্ম মতে, সূর্য কন্যা রাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষের সূচনা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময়ে পূর্বপুরুষরা পিতৃলোক ছেড়ে তাঁদের উত্তর পুরুষদের বাড়িতে অবস্থান করেন। পরে সূর্য আবার বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে তাঁরা পিতৃলোকে ফিরে যান। মহালয়ার অমাবস্যা তিথিতে সব পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা চলে । তবে, শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নয় ভগবান, পরলোকগত পিতা এবং মাতার উদ্দেশ্যে জল দান করা হয় তর্পণের মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই এমন দিনে লাখ লাখ মানুষ গঙ্গায় যান । পবিত্র গঙ্গার জল পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজন। পিতৃপক্ষের সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষজন ভিড় করেন মূলত কলকাতা শহরের মোট আটটি বড় গঙ্গার ঘাটে । তবে ছোটো-ঘাটগুলিতেও ভিড় লেগে থাকে । তথ্য বলছে, কলকাতায় ছোটো-বড় মিলিয়ে পঁচিশটি গঙ্গার ঘাট রয়েছে । মহালয়ার সকালে প্রতিটি ঘাটেই মানুষ আসেন। অনেকেই আসেন সপরিবারে। তথ্য বলছে, গত বছর আটটি বড় গঙ্গার ঘাটের প্রতিটিতে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল। পাশাপাশি কয়েক লাখ মানুষের সমাগম হয় দক্ষিণেশ্বর গঙ্গার ঘাটে । কিন্তু এই মহামারীর সময় এত মানুষের সমাগম হলে সেটাই হটস্পট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ রণজয় মজুমদার। তিনি বলেন, "মহালয়ার সকালে যেভাবে কাতারে কাতারে মানুষ গঙ্গার ঘাটে আসেন, এবার তাহলে যথেষ্ট চিন্তার কারণ রয়েছে । সেখান থেকেই সংক্রমণ ব্যাপক আকার নিতে পারে। নতুন করে তৈরি হতে পারে হটস্পট।" আর সেই কারণেই এবার তর্পণের জন্য বেশ কিছু নিয়ম নিষেধ বেঁধে দিয়েছে কলকাতা পৌরনিগম ।
সেই বিধিনিষেধে শিলমোহর দিতে আজ বৈঠকে বসেন আধিকারিকরা। পৌরনিগম সূত্রে খবর, একা তর্পণ করতে এলে তাকে বাধা দেওয়া হবে না । তবে এক জায়গায় অনেক লোক নেমে তর্পণ না করে, যাতে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখেন সেই বিষয়ে নজর রাখার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে তর্পণকারী ব্যক্তি, পুরোহিত সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য প্রশাসনকে সক্রিয় থাকার কথা বলেছে কলকাতা পৌরনিগম। পাশাপাশি যাঁরা তর্পণ করতে আসবেন তাঁদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘাটে নজরদারি চালানোর কথা বলা হয়েছে। তবে কলকাতা পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও SOP তৈরি করা হয়নি । এখন সাধারণভাবে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য যে সমস্ত নিয়মকানুন পালন করা হচ্ছে সেসবই পালন করা হবে। এ প্রসঙ্গে যুগ্মকমিশনার সদর শুভংকর সিনহা সরকার বলেন, "আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত এই সম্পর্কে কোনও নির্দেশ আসেনি । ব্যতিক্রমী কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হলে সেটি জানিয়ে দেওয়া হবে।"
কলকাতা পুলিশের ডিসি(বন্দর) ওয়াকার রাজাও জানিয়েছেন একই কথা । তবে মহালয়ার দিন সকালে প্রতিটি গঙ্গার ঘাটে কলকাতা পুলিশের তরফে থাকবে ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ। সক্রিয় থাকবে রিভার ট্র্যাফিক পুলিশ। থাকবে ডুবুরিরাও । মহালয়ার সকালের তর্পণের পর মাতৃদর্শন করেন অনেকেই । সেই কারণে দক্ষিণেশ্বর কলকাতাবাসীর অন্যতম গন্তব্য। এই মুহূর্তে উত্তর 24 পরগনা সংক্রমণের নিরিখে কলকাতাকে টেক্কা দিচ্ছে । আর সেই কারণে দক্ষিণেশ্বর মন্দির কর্তৃপক্ষ এবার মহালয়ার সকালে বন্ধ রাখছে গঙ্গার ঘাটগুলি । দক্ষিণেশ্বরে যে তিনটি গঙ্গার ঘাট রয়েছে তার কোনওটিতেই তর্পণ করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অছি ও সম্পাদক কুশল চৌধুরি । সূত্র জানাচ্ছে, এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের তরফে । সবদিক বিবেচনা করে মন্দির কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওইদিন সকালে বন্ধ রাখা হবে মন্দিরও।
এপ্রসঙ্গে ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা বলেন, "সরকারের যে গাইড লাইন আছে সেটিকেই মহালয়ার সকালের গুরুত্ব দেওয়া হবে। আলাদা করে কোনও গাইডলাইন এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি । তবে দক্ষিণেশ্বর মন্দির কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওইদিন সকালে সবকটি গঙ্গার ঘাট এবং মন্দির বন্ধ রাখার। শুধুমাত্র সকালে মন্দির বন্ধ থাকবে। বিকেলে যথারীতি মাতৃদর্শন চলবে।"
তবে মহামারীর এই সময় গঙ্গায় ভিড় না করার পরামর্শ দিচ্ছেন শাস্ত্রজ্ঞরা। সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ ডঃ জয়ন্ত কুশারি বলেন, "তর্পণের জন্য গঙ্গায় যেতেই হবে এমন কোনও বিধি নেই । বাড়িতেই শুদ্ধ রীতি মেনে তর্পণ সম্পন্ন করা যায়। এমনকী পুরোহিত ছাড়াও তর্পণ হতে পারে। আমি বলব, এই সময় সংক্রমণ রুখতে বাড়িতেই তর্পণ করার জন্য ।"
কলকাতার কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ রণজয় মজুমদার বলেন, "যেভাবে তর্পণের দিন লাখ লাখ মানুষের ভিড় হয় গঙ্গার ধারে তা এবার হলে যথেষ্ট চিন্তার কারণ রয়েছে। আমি বলব, পুরোহিতের পরামর্শ নিয়ে বাড়িতেই তর্পণ করার জন্য। সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধি শাস্ত্রে রয়েছে । এই মুহূর্তে কোরোনার মর্টালিটি রেট অনেকটাই কমেছে। এটা আশার কথা। কিন্তু সংক্রমণ প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। মহালয়ার দিন সকালে যদি লাখ লাখ মানুষ গঙ্গায় হাজির হন তবে, আমি নিশ্চিত নতুন করে হটস্পট তৈরি হবে। সেটা যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ। একান্তই যাঁরা গঙ্গায় আসবেন তাঁরা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতভাবে পালন করবেন । প্রশাসনের উচিত, সামাজিক দূরত্ববিধির বিষয়টি নিশ্চিত করা। আর এখন প্রকাশ্যে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক । সেটি মাথায় রাখতে হবে।"