হায়দ্রাবাদ, 19 ডিসেম্বর: কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, "যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী-যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।" সাতের দশকে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তান থেকে ভেঙে তৈরি হয় নতুন দেশ, বাংলাদেশ। তামাম দুনিয়ার ইতিহাসে আমেরিকা, ইজিপ্ট(মিশর) ও ফিলিপিন্স ছাড়া একমাত্র বাংলাদেশই এমন দেশ যারা স্বাধীনতা পেয়েছিল সরাসরি যুদ্ধে।
1971 সালের সেই গৌরবময় অধ্যায় 53 বছর বাদে 2024 সালে এক অন্য চেহারা নিয়েছে। জনতার রোষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা । ফ্রান্স থেকে দীর্ঘদিন বাদে দেশে ফিরে অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুস।
তবে তাতেও শান্তি ফেরেনি বাংলাদেশে। নতুন সরকারের বিরুদ্ধেও জনমত গড়ে উঠতে শুরু করেছে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই । শুধু তাই নয় এই অন্তর্বতী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। সম্প্রতি এ ব্যাপারে খানিকটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে ইউনুসের অন্তর্বতী সরকার।
বাংলাদেশের আদালত জানিয়েছে, সর্বসম্মতির ভিত্তিতেই অন্তর্বতী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাই এই সরকারকে অবৈধ বলা যায় না। কয়েক বছর আগে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের সংবিধানে একটি সংশোধন করেছিল। সেই অনুসারে বাংলাদেশে অন্তর্বতী সরকার বলে কিছু থাকবে না। এই সংশোধনী আংশিক খারিজ করেছে আদালত । আর সেই রায় নতুন অক্সিজেন জুগিয়েছে ইউনুসদের।
অন্যদিকে, দেশ ছাড়ার আগে পদত্যাগ করেননি বলে এখন বারবার দাবি করছেন হাসিনা। এমন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণের মতো ঘটনা। কিছুদিন আগে গ্রেফতার হওয়া হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাস এখনও বিচার পাননি। বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে তাঁর জামিনের শুনানিও।
সংঘাতের শুরু
মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের জন্য উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল বাংলাদেশে। দীর্ঘদিন ধরেই এই সংরক্ষণের প্রতিবাদ করে আসছে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে আরও অনেকে। 2018 সালে তৎকালীন হাসিনা সরকার এই সংরক্ষণ ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনে। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পুরনো ব্যবস্থাই ফিরে আসে।
জুন মাসের প্রথম থেকে নতুন করে ছাত্রদের আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। জুলাই মাসের পাঁচ তারিখ এই সংক্রান্ত একটি মামলায় রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট । সেই রায় থেকে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে যায় আদালত এই সংরক্ষণের পক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের প্রথমসারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে প্রতিবাদ শুরু হয়। ঢাকার কয়েকটি জায়গায় মিছিলও করেন ছাত্র-ছাত্রীরা। হয় রেল অবরোধ।
বেশ কয়েকদিন এভাবে আন্দোলন চলার পর হাসিনার দল আওয়ামী লিগের তরফে দাবি করা হয়, ছাত্ররা যা করছেন তা মেনে নেওয়া যায় না। এভাবে লাগাতার সুপ্রিম কোর্টের বিরোধিতা করা উচিত নয়। তবে তখনও পর্যন্ত সরকারের তরফে আন্দোলন দমন করতে পুলিশকে ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠেনি।
মুক্তিযোদ্ধারা না পেলে কী রাজাকাররা পাবেন?
ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন চিন সফরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ফিরে এসে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন। জুলাই মাসের 15 তারিখ গণভবন থেকে দেশবাসীর সঙ্গে কথা বলার সময় হাসিনা বলেন, “সংরক্ষণ নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। কিন্তু সংরক্ষণ যদি মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যরা না পান তাহলে কারা পাবেন? রাজাকারের পরিবারের সদস্যরা !”
হাসিনার এই মন্তব্যের পর দ্রুত ক্ষোভ বাড়তে শুরু করে । সেদিন সন্ধ্যা ছ’টার আশপাশে এমন মন্তব্য করেন হাসিনা। আর রাত ন'টা-সাড়ে নটার মধ্যে কার্যত গোটা দেশে তাঁর বিরুদ্ধে পদযাত্রা শুরু হয়ে যায়। পরিস্থিতি যে ধীরে ধীরে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় সেই রাতেই।
পাল্টা কৌশল নেয় সরকার। আওয়ামী লিগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লিগের নেতা-কর্মীদের সক্রিয় হতে বলা হয়। শুরু হয় সরাসরি সংঘর্ষ। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি
আন্দোলন তাতেও থামেনি। উল্টে সরকারের সঙ্গে সরাসরি হিংসায় জড়িয়ে পড়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা আহত হতে থাকেন। কয়েকজনের প্রাণও যায়। ঠিক এখান থেকেই পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ পেতে পুলিশ বাহিনীকে কাজে লাগানো হয়। তবে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ধীরে ধীরে আন্দোলনের চেহারায়ও পরিবর্তন আসে। উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরোধিতা করে শুরু হওয়া আন্দোলন ক্রমশ গণ আন্দোলনের চেহারা নেয়।
জুলাই মাসের শেষ দিকে স্পষ্টই বোঝা গিয়েছিল, এই আন্দোলন থামানো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা আলাদা করে বলতে হবে। আন্দোলন রুখতে সেনাবাহিনী অংশ নেবে কিনা এই প্রশ্ন যখন গোটা দেশে ঘুরছে, তখন সেনা প্রধান ওয়াকার উজ জামান জানান, “সেনাবাহিনী দেশের পাশে আছে।” আগস্ট মাসের 4 তারিখ থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। আন্দোলনের চাপে হাসিনা যে পদত্যাগ করতে পারেন এমন সম্ভাবনার গুঞ্জন শোনা যেতে থাকে ঢাকার অলিগলিতে।
অগস্ট মাসের 5 তারিখ ছিল সোমবার। সকাল থেকে ঢাকার রাস্তার দখল চলে যায় সাধারণ মানুষের হাতে । বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরফে হাসিনাকে বলা হয়, প্রায় চার লাখ লোক গণভবনের দিকে এগিয়ে আসছে। এদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়। তাই 45 মিনিটের মধ্যেই তাঁকে দেশ ছাড়তে হবে। সেই মতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন বলে খবরও সম্প্রচারিত হয় । বাংলাদেশ সেনার বিশেষ বিমান তাঁকে ও তাঁর বোন রেহানাকে নিয়ে ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। সেনার বিশেষ বিমান দিল্লির কাছে হিন্ডেনবার্গ বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে । ঠিক এই সময় থেকেই বাংলাদেশে শুরু হয় তাণ্ডবলীলা। গণভবনে হামলা চলে। বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নামাঙ্কিত মিউজিয়ামেও চলে হামলা। একদা যাঁকে সামনে রেখে মাথা তুলেছিল বাংলাদেশ সেই মুজিবের মূর্তি ধুলোয় মিশে গিয়েছে পদ্মাপাড়ে। পরে অবশ্য হাসিনা দাবি করেছেন তিনি পদত্যাগ করেননি । যে ছবি দেখিয়ে তাঁর পদত্যাগের কথা বলা হচ্ছে সেটা অনেক পুরনো।
শুধু তাই নয়, মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হাসিনা যে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন তাতেও নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেই পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ শাহাবুদ্দিনও বলেছেন, হাসিনার পদত্যাগ পত্র তিনি কখনও দেখেননি।
নির্বাচন কবে ?
মুজিব তনয়া দেশ ছাড়ার পর ক্ষমতায় এসেছেন ইউনুস। তিনি দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু নির্বাচিত সরকার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ বাংলাদেশেই। ইউনুস আগে বলেছিলেন তাঁর কমপক্ষে চার থেকে ছয় বছর সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে দেশের সংবিধানের পুনর্গঠন থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর কাজ করতে হবে। কয়েক মাস আগে দেশের সেনা প্রধান এক ব্রিটিশ সংবাদসংস্থাকে জানান, এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে দেশে ভোট হবে। পাল্টা ইউনুস জানান, কবে ভোট হবে সেই সিদ্ধান্ত সরকারের, সেনার নয়। আরও পরে সরকারের আইনি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, সামনের বছরের মধ্যেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এরপর সম্প্রতি বিজয় দিবসের ভাষণে ইউনুস জানান, 2025 সালের শেষ অথবা 2026 সালের শুরুর দিকে ভোট হবে বাংলাদেশে। সেই ঘোষণা আদৌ বাস্তবায়িত হয় কিনা, সেটা সময়ই বলবে।
চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপি
বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দল বলতে দুটি। শেখ হাসিনার আওয়ামী লিগ আর খালেদা জিয়ার বিএনপি। আওয়ামী লিগ এই মুহূর্তে কোণঠাসা আর তার সুযোগে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে বিএনপি। এই দলেরই বেশ কিছু নেতা একাধিকবার ভারত বিরোধী বক্তব্য রেখেছেন। চড়া সুরে বাংলা দখলের ডাকও দিয়েছেন কেউ কেউ । অন্যদিকে, ভারত সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা এই ধরনের বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে না। পাশাপাশি দুটি মামলায় যাবজ্জীবনের সাজা হয়েছিল খালেদা-পুত্র তারিক রহমানের। দুটি মামলা থেকেই খালাস পেয়েছেন তিনি । আগামীদিন খালেদা-পুত্র কিভাবে বিনপি-কে নেতৃত্ব দেন এবং হাসিনা-বিহীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, সেই দিকে শুধু নয়াদিল্লিই নয়, তাকিয়ে আছে আরও অনেকে।
ভারতের সংখ্যালঘু-উদ্বেগ
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ঘটে চলা অনেক ঘটনার সাথে সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণের ঘটনা ও অভিযোগ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ভারত । সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দাবী করা হয় অগস্টে হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণের 88টি ঘটনা ঘটেছে।
ঠিক এই সময়ই গ্রেফতার হয়েছেন বাংলাদেশের হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাস । তাঁর মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদও সংগঠিত হচ্ছে। হাত গুটিয়ে বসে নেই ভারত সরকারও। ইতিমধ্যেই সচিব পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিতে বাংলাদেশে গিয়েছেন ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি। বাংলাদেশের বিদেশ সচিবের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছে। দেখা হয়েছে ইউনুসের সঙ্গেও। বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিক্রম বলেছেন, বৈঠকে সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণের বিষয়টি তিনি তুলেছেন। ইউনুস সরকারও আশ্বাস দিয়েছে। আর তাতে হামলা বন্ধ হবে বলে আশা করছে ভারত। সম্প্রতি লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, বাংলাদেশে হিন্দু-সহ সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণের বিষয়ে ভারত সরকার উদ্বিগ্ন । সে কথা বাংলাদেশকেও জানানো হয়েছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ দ্রুত এই ধরনের হামলা রুখতে ব্যবস্থা নেবে।
ত্রিপুরায় হামলা, বাংলায় প্রতিবাদ
ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে আচমকাই ত্রিপুরায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলা চলে। চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে লাগাতার মিছিল হয়ে চলেছে ত্রিপুরায় । সেই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে ঢাকাও । ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠানো হয়। পাশাপাশি সাময়িক সময়ের জন্য উপ-হাইকমিশন বন্ধও রাখা হয় । এদিকে চিন্ময়কৃষ্ণের মুক্তির দাবিতে পথে নেমেছে বাংলার সাধু-সমাজ। তাতে যোগ দিয়েছে বিজেপিও। আর এই সুযোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও নিশানা করছে গেরুয়া শিবির। নিজেদের রাজনৈতিক অস্বিত্ব জানান দেওয়ার কোনও সুযোগই ছাড়তে রাজি নয় বিএনপিও। একাধিকবার আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত লং মার্চও করে তারা । প্রতিবারই নতুন করে ভারত-বিদ্বেষকে করে উস্কানি দেন বিএনপি নেতারা ।
নতুন দিনের নতুন আশা
রক্ত-সংঘর্ষ থেকে বড় রাজনৈতিক পালাবদল সবই দেখল বাংলাদেশ। ভয়াবহ বন্যায় স্বজন হারানোর কান্নাও আজ শোনা যায় আকাশে বাতাসে। এই হিংসা-হানাহানির ঝড় থেমে আগামী বছর বাংলাদেশে শান্তি আসবে এটাই সকলের কামনা।