কলকাতা, 8 ডিসেম্বর: সুন্দরবন (Sundarbans) ভয়ংকর সুন্দরের এক মিলনক্ষেত্র ৷ সেখানে জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ ! সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষ কার্যত জীবন হাতে নিয়ে বসবাস করেন ৷ আজকের শহুরে সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের জীবনযাত্রার অমিল অনেক ৷ খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের জীবন কাঠিন্যে ভরা ৷ একইসঙ্গে, তাঁদের নেই রাজ্যের বাসিন্দা বললেও ভুল হবে না ৷ প্রশাসন যখন তাঁদের দরজায় পৌঁছয়, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের প্রাথমিক চাহিদাগুলিই সরকারের কাছে তুলে ধরা হয় ৷ অন্তত ইভিএমে বোতাম টেপার আগে আর পাঁচটা সাধারণ নাগরিকের মতোই তাঁরাও আশা করেন, সরকার তাঁদের সেই প্রাথমিক পরিষেবাটুকু অন্তত দেবে ৷ যার মধ্যে আছে পানীয় জল, ঝকঝকে রাস্তা, আলো, সেতু ইত্যাদি ৷ কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় ৷ অথচ, ন্যূনতম সেই পরিষেবাটুকুও মেলে না !
সম্প্রতি উত্তর 24 পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ-সহ সুন্দরবনের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে দেখেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ৷ যে জায়গাটিকে এবার তিনি তাঁর সরকারি কর্মসূচি প্রদান অনুষ্ঠানের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, সেটি ছিল গভীর জঙ্গলে প্রবেশের আগে এই এলাকার শেষ জনপদ ৷
আরও পড়ুন: সুন্দরবনের বাঘ গুনতে ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু
মুখ্যমন্ত্রীর সেই সফরের ফাঁকেই এই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল ইটিভি ভারত ৷ অধিকাংশ বাসিন্দাই পানীয় জল সরবরাহ পরিষেবা না পাওয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা, বেহাল স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন ৷ লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই সমস্ত ইস্যুকে সামনে রেখে যাঁরা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন, তাঁর অধিকাংশই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক ! তাঁদের দাবি, ভোট দেওয়ার সময় তাঁরা শাসকদলকেই সমর্থন করেন ৷ কিন্তু, তবুও তাঁদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্যই থেকে যায় ৷
এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল জেলা প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে ৷ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ কেন সরাসরি উপভোক্তারা পাচ্ছেন না, এর কারণ কী, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল তাঁদের সামনে ৷ এক্ষেত্রে দুর্নীতি, সরকারি ও প্রশাসনিক অবহেলার মতো অভিযোগগুলি নিয়েও তাঁদের প্রশ্ন করা হয় ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিক জানান, সুন্দরবনের এইসব প্রত্যন্ত এবং দুর্গম এলাকা যতদিন বাইরের মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে থাকতে পারে, ততদিনই মঙ্গল ৷ কেন একথা বললেন তিনি ? আসলে ওই আধিকারিক উদ্বিগ্ন সুন্দরবনের ক্রমশ ধ্বংস হয়ে চলা বাস্তুতন্ত্র নিয়ে ৷ যা সরাসরি প্রভাবিত করছে স্থানীয় বাসিন্দাদের রোজনামচা ৷ তথাকথিত উন্নয়ন এই জঙ্গলের সবথেকে বড় শত্রু ! এমনটাই মনে করেন ওই আধিকারিক ৷ তিনি বলেন, জল-জঙ্গল-বন্যপ্রাণ ধ্বংস করে উন্নয়ন কাম্য নয় ৷ আবার নাগরিকের অধিকারও কোনও শর্তেই উপেক্ষিত হওয়া উচিত নয় ৷ তাই তাঁদের সবদিক বাঁচিয়ে চলতে হয় ৷ পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করার সঙ্গেই ভাবতে হয় বাস্ততন্ত্র রক্ষার মতো গুরুতর বিষয়টি নিয়েও ৷ এই কারণেই চাইলেই সুন্দরবনের যেখানে-সেখানে রাস্তা, সেতু তৈরি সম্ভব নয় ৷ সম্ভব নয় ইচ্ছা মতো বিদ্যুতের খুঁটি বা মোবাইলের টাওয়ার বসানো ৷
এই প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ পার্থ দে বলেন, সংশ্লিষ্ট দুই জেলা মিলিয়ে সুন্দরবনে প্রায় 45 লক্ষ মানুষ বসবাস করেন ৷ তাঁদের জীবন, জীবিকা ও উন্নয়নের কথা তো সরকারকেই ভাবতে হবে ৷ ভুলে গেলে চলবে না সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় নদীবাঁধগুলির অবস্থা শোচনীয় ৷ সামান্য জলোচ্ছ্বাসও বহু ক্ষেত্রে চাষের জমি থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি পর্যন্ত নোনা জলে ডুবিয়ে দেয় ৷ এখানে সরকারের একটা বড় দায়িত্ব নদীবাঁধ রক্ষা করা ৷ একইসঙ্গে, যে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনকে রক্ষা করছে, সেই বাদাবনেও গাছের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার ৷ একথা সত্যি যে রাস্তা, সেতুর মতো পরিকাঠামো এখানকার বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর ৷ অথচ, এখানেই বিঘার পর বিঘা ম্যানগ্রোভ কেটে চিংড়ির চাষ হচ্ছে ৷ বাস্তব হল, এই চিংড়ি চাষে সুন্দরবনের মানুষের তেমন কোনও উপকার হয় না ৷ বরং এর জেরে নদীর এবং এলাকার চাষাবাদের ক্ষতি হয় ৷ সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে ৷ মোটের উপর সরকারকে নাগরিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে হবে ৷ সেইসঙ্গে, সুন্দরবনকেও রক্ষা করতে হবে ৷
পার্থর এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া ৷ তিনি বলেন, সুন্দরবনের মানুষের জন্য এই সরকার যথেষ্ট ভাবছে ৷ সেই কারণেই শুধু সুন্দরবনকে নিয়েই আলাদা মাস্টার প্ল্যান করতে চাইছে রাজ্য সরকার ৷ ইতিমধ্যেই তা নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ সেই মাস্টার প্ল্যানের প্রধান বিষয় হল, এখানকার নদীগুলির স্বাস্থ্যরক্ষা এবং একইসঙ্গে নদীবাঁধ-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার উন্নয়ন ৷ পরিবেশ দফতর এবং বন দফতর একত্রে সুন্দরবন নিয়ে সামগ্রিকভাবে একটি 'নোট' তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছে ৷ সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ ৷ কিন্তু, ইতিমধ্যেই জলবায়ুর পরিবর্তনের জেরে এর প্রায় 2 হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছে ৷ পরিবেশ দফতর এবং বন দফতর ব-দ্বীপ বাঁচাতে ম্যানগ্রোভ সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছে ৷ এছাড়া, জলস্তর বৃদ্ধি নিয়ে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে ৷ সরকার সুন্দরবনের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে চিন্তিত ৷ কিন্তু, পরিবেশ বাঁচাতে কোথাও কোথাও সরকারকেও কঠোর পদক্ষেপ করতে হচ্ছে ৷