কলকাতা , 22 জুলাই : কোরোনা প্যানডেমিকের প্রভাব পড়েছে সব ক্ষেত্রে ৷ বিশেষ করে স্বাস্থ্যের উপর ৷ কোরোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হচ্ছেন ক্যান্সার রোগীরা । যার জেরে, চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগীর যেমন মৃত্যু হয়েছে , তেমনই রোগীদের বেড়ে গিয়েছে ক্যান্সার । অর্থাৎ ক্যান্সারের স্টেজ বৃদ্ধি পেয়েছ ৷ তার উপর লকডাউনের কারণে অর্থনীতি তলানিতে ৷ অনেকের কাজ চলে গেছে ৷ ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে ৷ এই পরিস্থিতিতে ব্যয়বহুল ক্যান্সারের চিকিৎসা কত জন করাতে পারবেন , তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ৷ এদিকে , বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য রাজ্যে সেরা ক্যান্সারের চিকিৎসাকেন্দ্র কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ৷ কিন্তু সেখানেও দীর্ঘদিন ক্যান্সারের চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ ছিল ৷ বর্তমানে তা চালু হয়েছে ঠিকই ৷ যদিও তা পুরোদমে শুরু হয়নি ৷
কোরোনা পরিস্থিতিতে ক্যান্সার রোগীদের অবস্থা এখন কী রকম ? কলকাতার বেসরকারি একটি হাসপাতালের চিকিৎসক সুজয় বালা বলেন , " যাঁদের ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল লকডাউনের কারণে তাঁরা মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন । এই জন্য অনেকেই সমস্যার মধ্যে পড়েছেন । কারণ ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হওয়ার পরে যদি মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায় , তাহলে অনেক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় । যাঁরা নতুন রোগী , তাঁরা হয়তো বাড়ি থেকে আসতে পারছেন না । আমাদের এই রকম অনেক রোগী রয়েছেন ।"
তিনি আরও বলেন , " ক্যান্সারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি । চিকিৎসা চলছিল , মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গিয়েছে । অথবা, ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়েছে । এই সব ক্ষেত্রে ক্যান্সারের স্টেজ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে । যে ক্যান্সার একটা স্থানে সীমিত ছিল , সেটা যদি শরীরের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যায় , তাহলে রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটা কমে যায় ।" ক্যান্সারের স্টেজ বেড়ে গিয়েছে , ফলে রোগীকে সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জও বেড়ে গিয়েছে ৷ এই প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক সুজয় বালা বলেন , " অনেক রোগীর স্টেজ বেড়ে গিয়েছে । নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে । অনেক ধরনের সমস্যা বেড়েছে । যেমন চিকিৎসা সমস্যা । কোনও রোগী হয়তো 2 নম্বর স্টেজ রয়েছে ৷ দীর্ঘদিন চিকিৎসা না হওয়ায় এখন ক্যান্সার বেড়ে 3 নম্বর স্টেজে চলে গিয়েছে । " আবার অনেকে আর্থিক সমস্যার জন্য চিকিত্সা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন, মন্তব্য চিকিত্সক বালার ।
তিনি আরও জানিয়েছেন , কোনও রোগী যদি কোরোনা আক্রান্ত হন , তাহলে এই অবস্থায় তাঁর ক্যান্সারের চিকিৎসা করা যাবে না যতক্ষণ না ওই রোগীর রিপোর্ট নেগেটিভ হচ্ছে । কারণ কোরোনা পজ়িটিভ থাকা অবস্থায় যদি ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয় , তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালের আর এক চিকিৎসক সুমন্ত দত্ত বলেন , "ক্যান্সারের চিকিৎসা বেশ ভালোরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । রোগীদের দিক থেকে যদি প্রথমে বলা হয় , তা হলে এই সময় রোগীরা দুই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন । এক , তাঁরা কীভাবে হাসপাতালে পৌঁছবেন । দুই , এখন অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কমে গিয়েছে ৷ এর জন্য অনেকেরই আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে ৷
তিনি আরও বলেন , " যদি ডেডিকেটেড COVID-19 এবং ডেডিকেটেড নন-COVID-19 হাসপাতাল হত , তাহলে সমস্যা হয়তো একটু কম হত । কিন্তু, এখনও পর্যন্ত তা করা যায়নি ৷ সেই জন্য রোগীরা হাসপাতালে আসতে ভয় পাচ্ছেন ৷ বিশেষ করে ক্যান্সারের রোগীরা । কারণ ক্যান্সারের রোগীদের ক্ষেত্রে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে এবং তাঁদের ক্ষেত্রে কোরোনা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে । থিওরিটিক্যালি , কোরোনায় আক্রান্ত হলে ক্যান্সারের রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার বেশি হতে পারে । "
দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করার দিকে লক্ষ্য রাখা হয় যাতে ক্যান্সারের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায় । এ কথা জানিয়ে ঠাকুরপুকুরের বেসরকারি একটি ক্যান্সার হাসপাতালের অধিকর্তা , চিকিৎসক অর্ণব গুপ্ত বলেন , " কোরোনার কারণে অনেকেরই সমস্যা হয়েছে । ক্যান্সার নির্ণয় করার পরেও অনেক রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করা যায়নি । যাঁদের কেমোথেরাপি-রেডিয়েশন শুরু হয়েছিল , তাঁদের মধ্যে যাঁরা হাসপাতালে আসতে পারেননি , তাঁদের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । যাঁদের অপারেশনের দরকার ছিল , অপারেশন করা যায়নি ৷ হাসপাতালেও সমস্যা দেখা দিয়েছিল । PPE, N95 মাস্ক সহ চিকিৎসক , নার্স , স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়েও দেখা দিয়েছিল সমস্যা । "
তিনি আরও বলেন , " সরকারি হাসপাতালে গেলে হয়তো বিনামূল্যে চিকিৎসা হচ্ছে । কিন্তু , অনেক লম্বা লাইন । অনেক হাসপাতাল এখন কোরোনা সেন্টার হয়ে গিয়েছে । অনেক জায়গায় কয়েকটি বেড কোরোনা রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে । অনেক চিকিৎসা-যন্ত্র , হাসপাতালের কর্মী এই কোরোনার চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত হয়েছেন । অন্যান্য রোগী বিশেষ করে ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে অসুবিধা তো হচ্ছে , কিছু বেসরকারি হাসপাতালেও হচ্ছে । "
এই রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে ক্যান্সারের সেরা চিকিৎসার কেন্দ্র হিসাবে রয়েছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল । অথচ, গত 7 মে থেক এই হাসপাতালকে টারশিয়ারি লেভেলের কোরোনা হাসপাতাল হিসেবে চালু করেছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর । ফলে এখানে ক্যান্সারের চিকিৎসা বন্ধ রাখা হয়েছিল । এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের 12টি বিভাগে MCI-এর প্রতিনিধি দল পরিদর্শনে আসবে বলে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এখানকার বিভিন্ন বিভাগের আউটডোর চালু করা হয় । তবে, লকডাউন শুরু হওয়ার আগে যেভাবে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে রোগীরা আসতেন , সেভাবে এখন আর আসতে পারছেন না । লকডাউন শুরু হওয়ার আগে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন 170 জন রোগী আসতেন । তখন প্রতিদিন এই হাসপাতালে রেডিয়েশন পেতেন এমন রোগীর সংখ্যা ছিল 150-র কাছাকাছি । কোনও রোগীর ক্ষেত্রে হয়তো 20 বা 25 দিন , কোনও রোগীর ক্ষেত্রে হয়তো টানা 30 দিন রেডিয়েশনের প্রয়োজন । এক্ষেত্রে রোগীরা টানা আসতেন । এখানে রেডিয়েশন অনকোলজি এবং মেডিকেল অনকোলজির জন্য পৃথক দুটি ডে-কেয়ার রয়েছে । মেডিকেল অনকোলজির ডে-কেয়ারে প্রতিদিন 20 জন ক্যান্সার রোগীর কেমোথেরাপি দেওয়া হত । লকডাউন শুরু হওয়ার আগে রেডিয়েশন অনকোলজির ডে-কেয়ারে প্রতিদিন 15-25 জন রোগীর রেডিয়েশন দেওয়া হত ৷
লকডাউনের সময় রোগীরা আর আগের মতো এই হাসপাতালে হাসপাতালে আসতে পারছেন না । এদিকে কোন দিন , কোন রোগীর রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপি চলবে , সেগুলি অন্তত মাস দেড়েক আগে থেকে নির্ধারিত থাকে । লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এই হাসপাতালকে কোরোনা হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণার আগে পর্যন্ত এমন হয়েছে , হয়ত 15 জনের তারিখ দেওয়া রয়েছে কোনও দিন , সেই দিন এসেছেন পাঁচজন । তার উপর COVID হাসপাতাল হিসাবে ঘোষণার জেরে এখানকার যে বিল্ডিংয়ে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে 68 টি বেড , সেই বিল্ডিং কোরোনা বিল্ডিং হয়ে গিয়েছে । কোরোনা হাসপাতাল করার জন্য এখানে কেমোথেরাপি , রেডিয়েশন বন্ধ করে দেওয়া হয় । বন্ধ করে দেওয়া হয় আউটডোর । তিন দিনের নোটিশে এটা করা হয়েছিল । এই অবস্থায় এখানকার রোগীদের অন্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় ।
গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালের 12 টি বিভাগে আউটডোর খোলা হয় ৷ ফলে রোগীরা আবার আসতে শুরু করেন । তবে, লকডাউন শুরু হওয়া থেকে এই সময় পর্যন্ত অনেক ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা হয়নি । আউটডোর আবার চালু হওয়ায় ডে-কেয়ারে কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে ৷ প্রতিদিন চার থেকে ছয়জন রোগী আসেছে । শুরু হয়েছে রেডিয়োথেরাপি । পুরানো রোগীরা আসছেন , নতুন রোগীরাও আসছেন । প্রতিদিন 10-12 জন করে বাড়তে বাড়তে 30-40 জন হয়েছেন । মেডিকেল অনকোলজি ডে-কেয়ারে এখন 10-15 জন রোগী আসছেন , রেডিয়েশন অনকোলজির ডে-কেয়ারে প্রতিদিন এখন সাত থেকে আট জন রোগী আসছেন । প্রতিদিন এখন রেডিয়েশন দেওয়া হচ্ছে 40-45 জন রোগীর । আউটডোরে এখন রোগী আসছেন । প্রথমে 15-20 জন রোগী , এখন 50 জনের কাছাকাছি রোগী আসছেন । তবে, লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে ফের এই হাসপাতালের আউটডোর চালু হওয়া পর্যন্ত এই সময়ে যে রোগীরা এখানে চিকিৎসার সুযোগ পাননি , তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই রোগ বেড়ে গিয়েছে ৷ শুধুমাত্র তাই নয় । অনেক ক্যান্সার রোগী হয়তো এখন আর বেঁচে নেই ।
কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের MD-র থার্ড ইয়ারের এক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ডাক্তার স্নিগ্ধা হাজরা বলেন, "রেডিয়েশন চলতে চলতে বন্ধ হওয়ার কারণে ক্যান্সার বেড়ে গিয়েছে । কিছু রোগীর ক্ষেত্রে প্ল্যান করা হয়েছিল কেমোথেরাপি অর্ধেক দেওয়ার পরে অপারেশন করা হবে । কেমোথেরাপি হয়েছে ৷ তবে সঠিক সময়ে অপারেশন করা হয়নি ৷ এই জন্য আবার কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে । এই পরিস্থিতিতে আমার ইউনিটের তিন জন রোগী মারা গিয়েছেন । "
এদিকে , এখানকার অন্য একটি ইউনিটের এক জন ক্যান্সার রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে । মেডিকেল অনকোলজি , সার্জিক্যাল অনকোলজি , রেডিয়েশন অনকোলজি এবং হেমাটোলজি । ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য এই চারটি বিভাগ একসঙ্গে রয়েছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য এই রকম ব্যবস্থা আর নেই । এই কারণে ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এই রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতাল । এখানে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য লকডাউন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত যাঁরা আসতেন, তাঁদের মধ্যে অনেক রোগীকে হয়তো আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি বলে মনে করছে চিকিৎসকদের বিভিন্ন অংশ । এই বিষয়ে চিকিৎসক স্নিগ্ধা হাজরা বলেন , "কোনও রোগী মারা গেলে সেভাবে তো খবর আমাদের কাছে আসে না । কারণ রোগী হয়তো বাড়িতে মারা যাচ্ছেন । যাঁদের সঙ্গে ফোনে নিয়মিত আমাদের কথা হয় বা যাঁরা আমাদের ফোন করেন , তাঁরা জানিয়েছেন তাঁদের রোগী মারা গিয়েছেন । তবে, কত জন মারা গিয়েছেন, তার হিসাব দিতে পারব না ।"