চন্দননগর, 25 জুন : উপমা নয়, বাস্তব ৷ আলো ডুবছে অন্ধকারে ৷ চন্দননগরের আলো ৷ কিছুদিন আগেও যেখানে সরকারি লাইট-হাব তৈরির কাজ চলছিল(যদিও তা মাঝপথে থমকে )। লকডাউন সেই চন্দননগরকে আচমকা অন্ধকূপে ছুঁড়ে ফেলেছে ৷ কাজ নেই ৷ রাতারাতি অসহায় হয়ে পড়েন অসংখ্য আলোকশিল্পী ও কর্মী ৷ দোসর হয়েছে ভারত-চিন যুদ্ধের আবহাওয়া ৷ যার জেরে চিনা সামগ্রী বয়কটের ডাক উঠেছে ! মেড ইন চায়না LED বাল্ব দিয়েই যে তাঁরা আলোর শিল্প ফুটিয়ে তোলেন । শুধু বাল্ব নয়, ইলেকট্রনিক সার্কিটও আসে চিন থেকে । সস্তা তাই পর্তায় পোসায় ৷ দেশি LED-র দাম দ্বিগুণ। এই অবস্থায় উৎসবের মরশুম তবু, চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা পেশা বদলের পথে ।
শ্রীকৃষ্ণ ইলেকট্রিক থেকে আটা কিনছেন মানুষ ৷ মডার্ন লাইটিং থেকে খাসির মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরছেন স্থানীয়রা ৷ চন্দননগরের আলোর বাজারের অবস্থা এই ৷ কোনও দোকানে আবার পাশাপাশি তাকে রাখা টুনিবাল্ব আর টুথপেস্ট৷ আলোকশিল্পের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর কথায়, উপায় ছিল না ৷ পেট বড় বালাই ৷ কোরোনা আবহওয়ায় নতুন অর্ডার নেই তো বটেই, পুরানো বায়নাও না হয়ে গেছে ৷ তার উপর ভারত-চিন সমস্যা! বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিনের ব্যবসা ছাড়তে হচ্ছে ৷
10-12 হাজার মানুষ জড়িয়ে চন্দননগরের আলোকশিল্পের সঙ্গে ৷ আগে টুনি বাল্বে কাজ করে চমকে দিতেন ওঁরা, ইদানিং হয় LED আর পিক্সেলের কাজ ৷ সামনে পরপর দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রী পুজো ৷ ব্যস্ততার সময় ৷ দেশে ও বিদেশে ৷ হ্যাঁ বিদেশেও ৷ প্রতি বছর কয়েকশো শিল্পী গোটা বিশ্বে চন্দননগরের আলোকশিল্পের মহিমা ছড়িয়ে দিতে পাড়ি দেন ৷ এত নাম এক্সক্লুসিভ মেকানিজ়িমের কারণেই । টম অ্যান্ড জেরির খুনসুটি থেকে লিয়নেল মেসির বাঁক খাওয়ানো ফ্রিকিকের লাইটিং দেখে যে ছোটোরা খুশি হয় ৷ হাততালি দিয়ে ওঠে ৷ তার পিছনে রয়েছে এই মেকানিজ়ম ৷ বড় বড় লোহার স্ট্রাকচার ৷ অটোমেটিক মেকানিজ়িমে আলোর সাহায্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে ৷ ফাইবারের উপর রকমারি LED-র নেভা-জ্বলা কাজ ৷ পুরো প্রক্রিয়ায় কত মানুষের শিল্পভাবনা আর পরিশ্রম জড়িয়ে ৷ তাঁরাই এখন বিদ্যালঙ্কার থেকে বাগবাজার পর্যন্ত রাস্তার পাশে হরেক ব্যবসা খুলে বসেছেন ।
এমনই এক আলোকশিল্পী মনোজ সাহা ৷ বলেন, "রথ, গণেশ-দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রী পুজোর উপর নির্ভর করে ব্যবসা । পিক সিজ়নে কাজ নেই ৷ আমার মতো অনেকেই মুদিখানা খুলেছেন । বলা হচ্ছে চায়নার সামগ্রী চলবে না । সরকার কি ভেবেছে কম দামে কোথা থেকে LED পাওয়া যাবে ? " তাঁর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী লাইট-হাব করার কথা বললেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সংকটে পড়া আমাদের নিয়ে কোনওরকম চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে না ।
আলোকশিল্পী রঞ্জিত দাসের কথায়, "লাইটের ব্যবসা কমপক্ষে আগামী এক বছর বন্ধ থাকবে । চিনা জিনিস আসছে না । বাধ্য হয়ে মুদির দোকান দিয়েছি । কদিন আগেও আমার কাছে 20-50 জন কাজ করতেন । তাঁরা আনাজের ব্যবসা করছেন, মাছ বেচে সংসার চালাচ্ছেন কেউ কেউ । সরকারি সহযোগিতা পেলে উপকার হবে ৷ "
আলোকশিল্পী পিন্টু মুখোপাধ্যায় বলেন, "লাইটের মেকানিজ়িমের কাজ করতাম । রাস্তায় বসে সবজি বিক্রি করতে পারছি না ৷ অটোমেটিক মেশিন তৈরি করছি ৷ কম দামি ৷ গৃহস্থের কাজে আসতে পারে ৷ রুটি বেলার মেশিন, সর্ষে ভেঙে তেল তৈরির ছোটো মেশিন ৷ এগুলো তৈরি করে বেচতে পারলে আমার সঙ্গে যে শ্রমিকরা কাজ করতেন তাঁরাও ফের কাজ পাবেন । "
আলোও যে অন্ধকার হতে পারে কে জানত লকডাউন না হলে !