কালচিনি (আলিপুদুয়ার), 24 নভেম্বর: চা বাগান লাগোয়া মাঠেই বিশাল এক শিরীষ গাছ ৷ একটা সময় এই এই গাছের নীচেই বসত মদের ঠেক, জুয়ার আসর ৷ সন্ধে নামলেই শুরু হত দুষ্কৃতীদের আনাগোনা ৷ সেই সমস্য়া থেকে মুক্তির উপায় দেখিয়েছেন স্থানীয় যুবক নিমেষ লামা ৷ পেল্লায় গাছকে ঘিরেই তৈরি করেছেন পাঠাগার ৷ সবাই ডাকে, 'ট্রি লাইব্রেরি' (Tree Library) বলে ! এখন আর এখানাকার বাতাসে মোদো গন্ধ ওড়ে না ৷ বদলে ভেসে আসে কচি গলায় গানের সুর ৷ মন ভরিয়ে দেয় গাছের ছায়ার মাঠে বসে থাকা খুদে পড়ুয়াদের ভিড় ৷ এই ছবি আলিপুরদুয়ারের (Alipurduar) কালচিনি (Kalchini) ব্লকের ৷
কীভাবে শুরু হল এই উদ্যোগ ? সদ্য স্নাতক নিমেষ লামা জানালেন, "আমি যখন এই ইউরোপিয়ান মাঠে খেলতে আসতাম, মাঠের পাশ দিয়ে যেতাম, দেখতাম গাছের নীচে জুয়া খেলা চলছে ৷ মদের ঠেক বসেছে ৷ তখন থেকেই মাথায় ঘুরত, কীভাবে এদের এখান থেকে সরাব ! তারপরই মনে হয়, আমরাও তো এদের মতোই গাছের তলায় আসর বসাতে পারি ! তবে, সেই আসর হবে বই পড়ার, গানের, কবিতার ৷"
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান ডি এম লাইব্রেরি
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ ৷ নিমেষের পাশে দাঁড়ান তাঁর বন্ধু ও কলেজের সিনিয়ররা ৷ লাইব্রেরি শুরু হয়েছিল মাত্র 25টা বই দিয়ে ৷ এখন বইয়ের সংখ্যা 400 ৷ গাছের গায়ে অস্থায়ী তাকে সাজানো থাকে সেইসব বই ৷ ছোট, বড় সকলেই এখানে আমন্ত্রিত ৷ বই পড়তে কোনও টাকা-পয়সাও দিতে হয় না ৷ এছাড়াও, প্রতি রবিবার বসে, 'সানডে আর্ট হাট' ! সেদিন কচিকাঁচারা থেকে শুরু করে যুবা, সকলেই মেতে ওঠেন গানে, কবিতায় ৷ আশপাশের বহু বাসিন্দা তাঁদের পরিবারের খুদে সদস্যটিকে ট্রি লাইব্রেরিতে রেখে যান নিমেষদের জিম্মায় ৷
2021 সালে জঁয়গার কলেজ থেকে স্নাতক হন নিমেষ ৷ বর্তমানে ডাব্লিউবিসিএস-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ৷ তাঁর মা রেণুকা লামা আইসিডিএস কর্মী ৷ একদিন মায়ের কাছেই অক্ষর জ্ঞান হয়েছিল নিমেষের ৷ আর আজ তাঁর উদ্যোগেই বইমুখী হয়েছে আশপাশের গ্রামের প্রায় 70 থেকে 80টি শিশু ৷ নিমেষের এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ৷ তাঁদের বিশ্বাস, নিমেষ যদি ভবিষ্যতে আমলা হন, তাহলেও এভাবেই মানুষের জন্য কাজ করে যাবেন ৷
নিমেষের এক বন্ধু দর্পণ থাপা বললেন, "নিমেষ আমাকে ফোন করে ওর উদ্যোগের কথা বলেছিল ৷ সেই শুনেই আমি এখানে প্রথম আসি ৷ ট্রি লাইব্রেরি দেখি ৷ আমার খুব ভালো লাগে ৷ আগে যেখানে লোকেরা মদ খেতে আসত, এখন সেখানেই এত ভালো একটা কাজ হচ্ছে ৷ এখন আমিও নিমেষের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছি ৷ শুধুমাত্র বাচ্চাদের বইমুখী করে তোলাই আমাদের উদ্দেশ্য নয় ৷ সেইসঙ্গে, তাদের সার্বিক বিকাশ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়েও আমরা সকলকে সচেতন করতে চাই ৷" একই সুর শোনা গিয়েছে নিমেষের আরও দুই বন্ধু অভয় ছেত্রী এবং লব গোলের গলাতেও ৷