কলকাতা, 12 অগাস্ট : তাস পিটিয়ে অর্জুন কিংবা এশিয়ান গেমসে সোনার পদক । যে খেলাটিকে ঘিরে এখনও জনমানসে সামান্য অসূয়া রয়েছে, সেই খেলাই এই কঠিন সময়ে নিঃশব্দে হয়ে চলেছে । দীর্ঘ তিন-চার মাস বন্ধ থাকার পর ধীরে ধীরে ফিরেছে ফুটবল, ক্রিকেটের মতো খেলাগুলি ৷ আর এখানেই আলাদা তাসের জগত ৷ টেকনোলজির হাত ধরে রমরমিয়ে চলছে সাহেব, বিবি, গোলাম, হরতন, রুইতনরা ৷
লকডাউনে "ওয়ার্ক ফ্রম হোম" শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি । কোরোনা ছোঁয়া থেকে বাঁচতে কর্পোরেট দুনিয়া কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করাচ্ছে । সেই অনুকরণে তাসের জগতে শুরু হয়েছে "ব্রিজ ফ্রম হোম" । দেশের নথিভুক্ত তাসুড়েরা বিভিন্ন ঘরোয়া টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছেন নিজেদের বাড়িতে বসে । বাড়িতে বসে টুর্নামেন্ট খেলছেন এশিয়াডে সোনাজয়ী হাওড়ার শিবনাথ দে সরকারও ৷ নিউ নর্মালে তাসের জগতের এই নতুন ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেছেন, "তাস এখন টেকনোলজি নির্ভর হয়ে উঠেছে । ব্রিজ ফ্রম হোম বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে হচ্ছে । গুজরাত, মুম্বই, দিল্লি থেকে খেলোয়াড়রা এই ফরম্যাটে অংশ নিচ্ছেন ।" একই সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন, "তাসের সঙ্গে অঙ্ক জড়িত । এখন তাস খেলায় লজিক এবং অঙ্ক জড়িয়ে । পারমুটেশন অ্যান্ড কম্বিনেশন সঠিকভাবে না করতে পারলে তাস খেলোয়াড় হয়ে ওঠা কঠিন । তাই পড়াশোনা জরুরি ।"
তাহলে কি তাস খেলায় জুটির সঙ্গে বোঝাপড়া, চোখের ঈশারা, শরীরি ভাষায় ছক তৈরির চেষ্টার ইতি ? ভুল শুধরে দিয়ে কাচ্চুদা বলে উঠলেন, "ভুল করছেন । আমাদের খেলায় মাঝখানে পার্টিশন থাকে । ফলে, পরস্পরকে বুঝে নেওয়া সম্ভব নয়," অনলাইন খেলার সময়ও প্রণবদা আমার জুটি, "প্রায় একই সঙ্গে যোগ করলেন ।" তাস মানেই আমজনতার খেলা । নতুন ধারার তাস খেলায় তাহলে কি শুধুমাত্র মেধাবীদের রাজত্ব ? প্রশ্নটা শেষ করার আগেই শিবনাথ দে সরকারের ঝটতি উত্তর, "মেরিটোরিয়াস এবং স্টুডিয়াসের মধ্যে যে পার্থক্য তাস খেলোয়াড় হয়ে ওঠার বিষয়টি ঠিক সেরকম । একজন ভালো তাস খেলোয়াড় হতে হলে তাসের ডিস্ট্রিবিউশনটা ঠিকভাবে জানতে হবে । তাহলেই একজন অতিসাধারণ মানুষও ভালো খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারবেন ।"
হাতুড়ে পদ্ধতিতে তাসের খেলোয়াড় তৈরি বন্ধ করতেই অ্যাকাডেমি করছেন তাসের দুনিয়ার কাচ্চু দা । বাড়িতে উৎসাহী যুবকদের ভিড় । তাঁদের সঙ্গে কার্যত সারাদিন তাস খেলে চলেছেন । ভুল হলে ধরিয়ে দিচ্ছেন । সেই ফাঁকেই বললেন, "আমার একটা জমি রয়েছে । ওখানেই অ্যাকাডেমি করব । সামান্য সমস্যা রয়েছে, তবে তা মিটে যাবে । একটা নিরাপত্তা চাই আমার । কারণ, উন্নতমানের প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খেলা শেখানো হবে । যখন কোনও ব্যক্তি তাস খেলবেন তখন তাঁর সঙ্গে প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশ থেকে কোনও বিখ্যাত খেলোয়াড়ের যোগাযোগ থাকবে । ভুল করলে তিনি তৎক্ষণাৎ শুধরে দেবেন ৷ "
সারাবছর পাঁচটি গ্রা পি টুর্নামেন্ট ছাড়াও মোট 12টা টুর্নামেন্ট খেলেন শিবনাথ দে সরকার এবং প্রণব বর্ধন । তবে, অনলাইনে যেহেতু চোখের ওপর চাপ পড়ে তাই অতটা চাপ নেন না । তাস নিয়ে একটা সমাজ সংস্কারের ব্রত নিয়েছেন । সেই ব্রত পালনে তাঁরা যে সফল তা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট । আগে রাজ্যে নথিভুক্ত খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল প্রায় 2700 । এখন সেটা প্রায় ছয় হাজার । মহারাষ্ট্রে সংখ্যাটা বেশি । তবে এ রাজ্যেও আগ্রহ বাড়ছে ৷ বলছেন শিবনাথ দে সরকার । ইতিমধ্যে তাস খেলার সফলদের চাকরি দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি । লকডাউনের বাজারে চাকরি হারানোর যে আতঙ্ক ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে সেখানে 17 জন তাস খেলোয়াড় চাকরি পেয়েছেন ।
তাস এখন আর সর্বনাশা নয় । তাস খেলার নৈপুণ্য মজবুত ভবিষ্যৎ এবং সম্মানজনক জীবন গঠনের মঞ্চ । যা লকডাউনের কঠিন সময়েও নীরবে বিপ্লব করে চলেছে ।