শিলিগুড়ি, 7 অক্টোবর : প্রথমে ডাকা হয়েছিল গোর্খাল্যান্ড নিয়ে বৈঠক ৷ প্রতিবাদ করে রাজ্য ৷ তারপর সংশোধিত চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় সরকার ৷ বৈঠকটি GTA-র পরিচালনা সংক্রান্ত বলে দাবি করা হয় সেখানে ৷ আজকের সেই বৈঠকে পাহাড়ের কোন নেতারা যোগ দেবেন ? রাজ্যের প্রতিনিধি কি থাকবে ? উঠছে হাজারও প্রশ্ন ৷ এই অবস্থায় মনে পড়বেই গোর্খাল্যান্ডের দাবির দীর্ঘ ইতিহাস ৷
রাজ্যে তখন ক্ষমতাসীন বামেরা । সময়টা আশির দশক । পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু করেন সুবাস ঘিসিং । পাহাড়জুড়ে তখন শুধুই ঘিসিং-এর দাপট । দাবি ওঠে পার্বত্য এলাকাকে নিয়ে আলাদা রাজ্যের । দীর্ঘ সংঘাত শেষে দার্জিলিং জেলা পরিষদকে ভেঙে 1988 সালে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল (DGHC) তৈরি হয় ৷ মসনদে বসানো হয় সুবাস ঘিসিং-কে। সাময়িক সন্ধিতে স্বস্তি ফেরে পাহাড়ে । কিন্তু ততদিনে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে নিজস্ব জাতিসত্তার আবেগ চেপে বসেছে । ফলে সাময়িক সন্ধি হলেও কখনও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, কখনও আবার রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে দাবি ওঠে, তা পাহাড়ের আমজনতার মনে গেঁথে যায় । অন্যদিকে সুবাস ঘিসিং বুঝতে পারেন, দার্জিলিং হিল কাউন্সিলকে সামনে রেখে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা যাবে না । পাহাড়ে নিজেদের মৌরসিপাট্টা বজায় রাখতে হলে পাহাড়ের মানুষকে যে স্বপ্ন তাঁরা দেখিয়েছিলেন সেই স্বপ্নের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে । সুবাস ঘিসিং ফের জানিয়ে দেন, পাহাড়ের মানুষের প্রত্যাশাপূরণে কার্যকর নয় দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল । এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা GNLF। দাবি ওঠে ষষ্ঠ তপসিলের । এদিকে সেখানকার রাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখে পাহাড়কে শান্ত করার চেষ্টা শুরু করে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার ।
এরপরই পাহাড়ের প্রত্যাশা পূরণে সেখানে আসে কেন্দ্রীয় সংসদীয় প্রতিনিধি দল । সেই সময় সুবাস ঘিসিংয়ের আধিপত্য অনেকটাই কমেছে । তাঁর ষষ্ঠ তপসিলের দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেদের রাজনৈতিক জমি শক্ত করে ফেলে গুরুং শিবির । পাহাড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদল জানিয়ে দেয়, স্বায়ত্তশাসনের নামে পাহাড়কে ষষ্ঠ তপসিলভুক্ত করার দাবি সর্বজনসম্মত নয় । এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বাম সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিলের চেয়েও শক্তিশালী গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গঠন করা হবে । তৈরি হয় খসড়া । কিন্তু ওই সময়ে রাজ্যে টলমল করছে ক্ষমতাসীন বাম শিবির । এরপর ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস ।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল পাহাড়কে শান্ত করার । ওই সময়কালে সুবাস ঘিসিং কার্যত পাহাড়ছাড়া হন । পাহাড়ের রাজনীতির রাশ তখন বিমল গুরুং-এর হাতে । এলাকার মানুষের ভাবাবেগকে সামনে রেখে বিমল গুরুং সরব হোন আলাদা রাজ্যের দাবিতে । শুরু হয় তাদের শান্ত করার পালা । দিল্লিতে তখন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার । ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডেকে 2011 সালেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দিল্লিতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের উপস্থিতিতে গুরুং শিবির GTA চুক্তি করে । ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে গুরুংদের চাপে লিখে দেওয়া হয়, পাহাড়ের মানুষের প্রত্যাশাপূরণে গঠন করা হচ্ছে আরও শক্তিশালী গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা GTA । একই সঙ্গে চুক্তিতে লেখা হয়, পাহাড়ের মানুষের প্রত্যাশাপূরণে পৃথক রাজ্যের যে দাবি তা পরবর্তীকালে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে । এতে ফের শান্ত হয় পাহাড় । কিন্তু আলাদা রাজ্যের দাবি থেকেই যায় । যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন পাহাড় হাসছে । কিন্তু সেই হাসি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি । এরমধ্যে গুরুং শিবির সেই সময়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন BJP সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে । সেই হাওয়াতেই দার্জিলিং লোকসভা আসনে জিতে যান BJP প্রার্থী যশবন্ত সিনহা । পরের বার জেতেন সুরেন্দর সিং আলুওয়ালিয়াও । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এককালে মা বলে সম্বোধন করলেও পরবর্তীকালে বিমল গুরুং বুঝতে পারেন নবগঠিত গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে । তা ছাড়া চুক্তি মোতাবেক GTA পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দপ্তর রাজ্য হস্তান্তরিত না করায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হচ্ছে GTA প্রশাসকদের ।
2017 সাল । রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মোর্চার সম্পর্কে ভাঙন ধরে । এই বছরেই ফের শুরু হয় আন্দোলন । GTA চুক্তির কপি জ্বালিয়ে দিয়ে পাহাড়ে ফের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু করে বিমল গুরুংয়ের নেতৃত্বাধীন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা । শুরু হয় রাজ্যের সঙ্গে প্রবল সংঘাত । পাহাড়জুড়ে শুরু হয় বনধের রাজনীতি । পাহাড়ে অর্থনীতির মূল ভিত্তি পর্যটন এবং চা শিল্প বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । অন্যদিকে পাহাড়জুড়ে একের পর এক থানা, সরকারি সম্পত্তি জ্বালিয়ে দিয়ে আন্দোলনে নামেন বিমল গুরুং । পাহাড়ে চলে টানা 102 দিনের বন্ধ ৷ সেই সময় পাহাড়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, বাংলা ভাগের চেষ্টা মানবেন না তিনি । উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে কার্যত এই আন্দোলনকে দমনে উদ্যত হয় রাজ্য সরকার । এদিকে হিংসাত্মক আন্দোলনের জেরে অসংখ্য মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন বিমল গুরুং । তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় তদন্ত শুরু হয় ৷ গুরুং-এর আস্তানায় তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ ও প্রশাসন । বাধ্য হয় পাহাড় ছেড়ে দীর্ঘ অজ্ঞাতবাসে যান বিমল গুরুং । সেই সুযোগ কাজে লাগান বিনয় তামাং । বিনয় তামাং-কে GTA প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব দেয় রাজ্য সরকার । তৈরি হয় বিনয়পন্থী মোর্চা । পাহাড়ে তৈরি হয় প্রশাসক বোর্ড । কিন্তু পাহাড়বাসীর মন জয় করতে পারেননি বিনয় তামাংও । এরপরও রাজ্যের শাসকদল গত বিধানসভা নির্বাচনে পাহাড়ে বিনয় তামাং-কে সঙ্গে নিয়ে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নেয় । বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীও হন স্বয়ং বিনয় তামাং। GTA পরিচালনার ভার তুলে দেওয়া হয় অনিত থাপার হাতে । কিন্তু নির্বাচনে পরাজিত হন বিনয় তামাং । পাহাড়ের বাসিন্দারা বুঝিয়ে দেন, রাজ্যের সঙ্গে সন্ধি করে বিনয় তামাং শিবির ক্ষমতাসীন হলেও পাহাড়ের মানুষ তাদের ভালো চোখে দেখেনি । অন্যদিকে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে অন্তরালে থেকেও বিভিন্ন ইশুতে ভিডিয়ো বার্তা দিতে থাকেন বিমল গুরুং । এদিকে উন্নয়নকে সামনে রেখে পাহাড়ে নানা কর্মকাণ্ড শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ।
রাজ্যের পুলিশ এবং CID অসংখ্য মামলায় বিমল গুরুং-কে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও হদিশ পায়নি ! বিমল গুরুং-ও বুঝতে পারেন রাজ্যের শাসক দল তাঁর দাবি-দাওয়া মানবে না। এমত অবস্থায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন BJP শিবিরের দরবার করেন বিমল গুরুং । উল্লেখ্য, গুরুং-এর সঙ্গে হাত মেলানোতেই গত লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হন BJP প্রার্থী রাজু বিস্তা । BJP-র তরফে বিমল গুরুংদের আশ্বাস দেওয় হয় ছোটো রাজ্যের পক্ষপাতী তারা। তাই পাহাড়ের পৃথক রাজ্যের দাবিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে । বস্তুত গুরুংয়ের চাপে লোকসভা নির্বাচনের আগেই দলের ইস্তেহারে গোর্খাল্যান্ডের কথা উল্লেখ করেছিল BJP ।
এর মধ্যে দেশে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসেন নরেন্দ্র মোদি । তা সত্ত্বেও পাহাড়ের প্রত্যাশা পূরণে পৃথক রাজ্যের দাবির বাস্তবায়ন হয়নি । অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে অন্তরালে থেকে বিমল গুরুং শিবিরের নেতারা উপলব্ধি করেন, রাজ্যের বিরোধিতা বজায় থাকলে পৃথক রাজ্যের দাবি কিছুতেই মিলবে না । এর ফলে BJP-র সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয় গুরুং শিবিরের । আর তা বুঝতে পেরেই ফের সক্রিয় কেন্দ্র ।
গত মাসে GTA-র পরিচালনা সংক্রান্ত পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের ডাক দেয় কেন্দ্রীয় সরকার । যদিও সেই বৈঠকে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দেয় রাজ্য । ভেস্তে যায় বৈঠক। নতুন করে দিন দু'য়েক আগে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে আরও একবার ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকে কেন্দ্র । সেই বৈঠকের চিঠি পাঠানো হয়েছিল রাজ্য সরকারের কাছে । চিঠি যায় দার্জিলিং জেলা প্রশাসন, GTA পরিচালনার দায়িত্বে থাকা পাহাড়ের নেতাদের কাছেও । বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয় দার্জিলিংয়ের সিংমারিতে ৷ বিমল গুরুং-এর ঠিকানায় । এদিকে চিঠি পেয়ে ক্ষুব্ধ নবান্ন জানায়, বাংলা ভাগের চেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না । কোনও ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেবে না রাজ্য । এরপর ভোলবদল করে গতকালকেই সংশোধিত নতুন চিঠি পাঠায় কেন্দ্র । তাতে জানানো হয়, বৈঠক গোর্খাল্যান্ড নিয়ে নয়, গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়েই । তবে সংশোধিত চিঠিতে ক্ষমতাসীন বিনয় তামাংদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি ৷ বরং ডাক পেয়েছেন বিমল গুরুং ৷ এই প্রসঙ্গে বৈঠক নিয়ে আপত্তি তোলে বিনয়পন্থী মোর্চা নেতারা । তবে সমশোধিত বৈঠকে রাজ্য সরকার যাবে কি না তা এখনও জানা যায়নি । যদিও বৈঠক নিয়ে আশাবাদী বিমল গুরুং শিবির ।
অন্তরাল থেকেই বিবৃতি দিয়েছেন রোশন গিরি ৷ জানিয়েছেন, পাহাড়ে প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে বৈঠক ডেকেছে কেন্দ্র । এই বৈঠকে অংশ নিতে চান তাঁরা । বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য পাহাড়ে দ্বিতীয় বড় দল GNLF নেতা সুবাস ঘিসিং-এর পুত্র মন ঘিসিং-কে চিঠি দিয়েছেন রোশন গিরি । বৈঠকে মোর্চার প্রতিনিধি দলের হয়ে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে তাঁকে । সব মিলিয়ে আজকের প্রস্তাবিত বৈঠক ঘিরে হইচই শুরু হয়েছে পাহাড়জুড়ে । অন্যদিকে এর বিরোধিতায় পথে নেমেছে তৃণমূল ।
শিলিগুড়িতে পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলা ভাগের চেষ্টা কিছুতেই মানবে না রাজ্য ৷ বামেরাও জানিয়েছে, পৃথক রাজ্য পাহাড় সমস্যার সমাধান নয় ৷ পাহাড়ে দরকার স্বায়ত্বশাসন ৷ তাদের কথায়, বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ তবে, পাহাড় সমস্যা মেটাতে প্রয়োজনে সর্বদল বৈঠক ডাকা উচিত বলে মনে করে বামেরা । উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আজকের বৈঠক হয় কি না, হলে সেখানে কী সিদ্ধান্ত হয় তা জানতে কৌতূহলী পাহাড়ের বাসিন্দারা ।