কলকাতা, 14 জুলাই : টানা পাঁচ-ছয় ঘণ্টার সাইক্লোন। আরও একবার কেঁপে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকা এবং সুন্দরবন । ভেঙেছে বহু গাছ । ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের । তার জেরে এই তল্লাটের অধিবাসীদের কথা কহতব্য নয় । এমনিতেই মাছ ধরে, মধু ভেঙে কিংবা ছোটো জমিতে চাষ করে হয় দিনগুজরান । রাজ্যের দরিদ্রতম এই তল্লাট। তার মাঝে টালি কিংবা অ্যাডবেস্টারের ছাদের নিচে সুখী গৃহকোণ। কিন্তু, সেই সুখটুকুও কেড়েছে ঘূর্ণিঝড় আমফান । উড়িয়ে নিয়ে গেছে চাল। ভেঙেছে বাঁধ । নোনাজল ঢুকে চাষবাসের দফারফা । সব মিলিয়ে আয়লার পর ফের বিপর্যস্ত সুন্দরবন। মানুষের এই বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছে সহ-নাগরিকরা। তারা ছুটে যাচ্ছে ত্রাণ নিয়ে। আর সুন্দরবনের বাঁধের ধারে ত্রাণের আশাতেই বসে থাকে আদুরে গায়ের শিশু, কিংবা ক্ষুধার জালায় জ্বলতে থাকা গাঁয়ের বধূ। ত্রাণ নিয়ে কেউ পৌঁছালে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওদের মুখে । কিন্তু, সহ-নাগরিকদের মানবিক মুখের আড়ালে ঢুকছে লাখ লাখ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ । এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পরিবেশবিদরা ।
ক্যালেন্ডারে তারিখটা ছিল 20 মে। সুন্দরবনে জবাকুসুম অবশ্য আবির্ভাব হননি সেদিন। সকাল থেকেই কালো মেঘে ঢেকেছিল আকাশ। দমকা বৃষ্টি, তীব্র বেগে হাওয়া, চিল চিৎকারে পাখিদের আশ্রয়ের খোঁজ জানান দিচ্ছিল আবহাওয়া দপ্তরের ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়ে পড়তে চলেছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আমফান । পরিবেশের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করে বেঁচে থাকা সুন্দরবনের যুবকের দল তার মাঝেই দেখে এসেছে নিজের এলাকার বাঁধ । কোথাও সেই বাঁধের দুর্বল অবস্থা দেখলে কয়েক কোদাল মাটি দিয়ে এসেছে । পরিবারের লোকজনকে পাঠানো হয়েছে দূরের স্কুলবাড়িতে । ঝড়ের গতিবেগ বাড়লে ঘরের মায়া ত্যাগ করে সবাই তখন নিরাপদ আশ্রয়ে । অনেক রাত পর্যন্ত চলে ঝড়ের তাণ্ডব । গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় 140 থেকে 160 কিলোমিটারে । অনেক রাত পর্যন্ত চলে তাণ্ডবলীলা । সুন্দরবনের বাসিন্দারা বুঝে গিয়েছিলেন, আবারও তারা গৃহহীন হয়েছেন। আমফান পরবর্তীতে রাজ্য সরকারের তরফে কেন্দ্রকে দেওয়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, মূলত দুই 24 পরগনা এবং মেদিনীপুরে দেড় হাজার মৌজায় 21 লাখ বাড়ি ভেঙে গেছে । যার জেরে গৃহহীন প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষ। এটাই সব থেকে বড় ক্ষয়ক্ষতি । ফসলের ক্ষতি হয়েছে 21 হাজার কোটি টাকারও বেশি। নদীবাঁধের ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। সোশাল মিডিয়ায় সেই দিন ট্রেন্ড ছিল #pray for Bengal ।
এক বুক জলে দাঁড়িয়ে সুন্দরবনবাসীর হাহাকার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল সহ-নাগরিকদের। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ বা প্রতিবেশী রাজ্যের বহু হৃদয়বানের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল সর্বহারা মানুষগুলোর জন্য । তাই তো তারা ছুটে গিয়েছিল সুন্দরবনে । যে যেমনভাবে পেরেছে বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত । শুকনো চিড়ে, মুড়ি, পাউরুটি, চাল, আলু, ডাল থেকে শুরু করে জামা-কাপড় সব পৌঁছে দিয়েছে সুন্দরবনের বাসিন্দাদের হাতে। এখনও বহু মানুষ ত্রাণ পৌঁছে দিতে যাচ্ছে সুন্দরবনে। দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া লাখ লাখ প্লাস্টিকের প্যাকেটের মাধ্যমে সেই ত্রাণ পৌঁছে গেছে সেখানে । আর এতেই সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের বড়সড় ক্ষতি হচ্ছে ।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক প্রবীরকুমার বসু-র তথ্য অনুসারে ত্রাণের জন্য ইতিমধ্যেই সুন্দরবন এলাকায় ঢুকেছে প্রায় কয়েকশো টন প্লাস্টিক । সত্যিই চিন্তায় ফেলার মতো তথ্য। এত প্লাস্টিক সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করবে বলে নিশ্চিত প্রবীরকুমার বসু । তথ্য বলছে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে এক থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ৷ বছরে পাঁচ ট্রিলিয়ন যা প্রায় প্রতি মিনিটে দশ মিলিয়ন প্লাস্টিকের সমান ৷ যদি এই সমস্ত প্লাস্টিক ব্যাগগুলিকে একত্রিত করা যায় তাহলে প্রতি ঘণ্টায় সাতবার বিশ্বের চক্কর লাগাতে পারবে ৷ বা ফ্রান্সের মতো প্রদেশকে দুই বার ঢেকে দেওয়া যাবে এই প্লাস্টিক দিয়ে ৷ তথ্য বলছে, এই প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি গড়ে 12 মিনিট ব্যবহার করা হয়ে থাকে ৷ তারপর যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয় ৷ সারা বিশ্বে মাত্র এক থেকে তিন শতাংশ প্লাস্টিক ব্যাগ পুনর্নবীকরণ করা হয় ৷ প্রাকৃতিক পরিবেশের উষ্ণতা ও আদ্রতার উপর নির্ভর করে একটি প্লাস্টিক ব্যাগ নষ্ট হতে সময় লাগতে পারে 15 থেকে এক হাজার বছর ৷
আমফান তো রয়েইছে সেই সঙ্গে তালে তাল মিলিয়েছে কোরোনা ভাইরাস ৷ সুন্দরবনের মানুষদের কোরোনার হাত থেকে রক্ষা করতে লড়াই চালাচ্ছেন ডাক্তার ভাস্করদেব মুখোপাধ্যায়। তিনিও মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন ত্রাণ । তিনি বলেন, "ওখানকার যে সমস্ত পরিবারের ক্ষতি হয়েছে তাদের হাতে ত্রাণ পৌঁছে না দিলে মানুষগুলো শেষ হয়ে যাবে । এটা ঠিক যে ত্রাণ পৌঁছাতে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিক । এছাড়া তো উপায়ও নেই । তবে সুন্দরবনের মানুষ সচেতন। আমরাও তাদের জানিয়েছি কীভাবে নষ্ট করতে হবে এই প্লাস্টিক । সুন্দরবনকে বাঁচাতে পারে তারাই ।" কিন্তু কীভাবে সেই প্লাস্টিক নষ্ট হবে তার কোনও দিশা দেখাতে পারেননি তিনি ।
যদিও HH চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মতো কয়েকটি সংগঠন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে । তারা কাপড়ের ব্যাগে পৌঁছে দিয়েছে ত্রাণ । পুরো বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক প্রবীরকুমার বসু বলেন, "গোটা পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত পাঁচ বিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক প্রকৃতির সঙ্গে মিশেছে । যা পরিবেশের চূড়ান্ত ক্ষতি করেছে । আমফান পরবর্তী সুন্দরবনের ত্রাণ পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রায় এক হাজার টন প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এগুলো সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করবে। সুন্দরবনের চাষাবাদের জমিতে প্লাস্টিক মিশে উর্বরতা নষ্ট করবে । সর্বোপরি নদীতে মিশে সেগুলি সমুদ্রে পৌঁছে যাবে । যা সমুদ্রের ইকোসিস্টেমকে নষ্ট করে দেবে । সুন্দরবন অঞ্চলে মাছেরও প্রভূত ক্ষতি করবে এই প্লাস্টিক ।"
তাহলে এর থেকে মুক্তির উপায়?
প্রবীরবাবু বলেন, "পাঠ কিংবা কাপড়ের ব্যাগ এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারত । কিন্তু, এটাও মাথায় রাখতে হবে বর্ষায় সেই ব্যাগের মাধ্যমে মুড়ি-চিড়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এখন গাছ থেকে বায়োডিগ্রেবল প্লাস্টিক তৈরির চেষ্টা চলছে । কিন্তু, সেটাতেও সমস্যা আছে । তার জন্য কাটতে হবে প্রচুর গাছ । আর তাই ওপেন হাউজ় ইউনিভার্সিটি পলিমার থেকে প্লাস্টিক বানানোরও চেষ্টা চালাচ্ছে । যা বায়োডিগ্রেবেল হবে । তেমন প্লাস্টিক যদি তৈরি করা যায় সেটাই হবে সব থেকে ভালো সমাধান ।"