কলকাতা, 6 মে: একদিকে রক্তের সংকট, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট। এর সঙ্গে রয়েছে COVID-19 সংক্রমণের আশঙ্কা। চলছে লকডাউন। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত সন্তানদের বাঁচাতে পারবেন তাঁরা, এই চিন্তায় অন্য কিছু আর এখন ভাবতে পারছেন না বহু অভিভাবক। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হতে পারে, তাও অনিশ্চিত। যার জেরে তাঁদের উদ্বেগ বেড়ে চলেছে।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের অভিভাবকদের সংগঠন থ্যালাসেমিক গার্জিয়ানস অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য গৌতম গুহ জানিয়েছেন, এ রাজ্যে 50 হাজারের মতো থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছেন, যাঁদের নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন। কারও ক্ষেত্রে মাসে একবার অথবা, কারও ক্ষেত্রে মাসে দুইবার রক্তের প্রয়োজন।
প্রতি সপ্তাহে রক্তের প্রয়োজন, থ্যালাসেমিয়ায় এমন আক্রান্তও রয়েছেন। থ্যালাসেমিকদের জন্য "হোল ব্লাডে"র প্রয়োজন নেই। হোল ব্লাডে প্লাজমা থাকে, এই ব্লাড দেওয়া হলে কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। কারণ, প্লাজমার ভিতরে বিভিন্ন অ্যান্টিবডি থাকে। এই অ্যান্টিবডির কারণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এই জন্য থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের PRBC অর্থাৎ, ঘনীভূত লোহিত রক্ত কণিকা দেওয়া হয়।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের অভিভাবকদের সংগঠনের এই সদস্য বলেন, "জেলার ব্লাডব্যাঙ্কগুলিতে PRBC পাওয়া যায় না। এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা না থাকলে কলকাতার উপর চাপ কমত।" এমন সমস্যার জেরে বহু অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের কলকাতায় নিয়ে আসেন রক্ত দেওয়ার জন্য।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের অভিভাবকদের এই সংগঠনের একটি সেন্টার রয়েছে উত্তর কলকাতায়, এই সেন্টারেও রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। নিয়মিত বহু অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের এই সেন্টারে নিয়ে আসেন। কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালেও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে আসেন অভিভাবকরা। তবে, লকডাউন শুরু হওয়ার পরে সমস্যা আরও বেড়ে চলেছে তাঁদের।
থ্যালাসেমিয়ায় এমন বহু আক্রান্ত রয়েছে, যাঁদের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। কলকাতায় থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের অভিভাবকদের ওই সেন্টারের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট গৌতম গুহ বলেন, "কেউ ক্ষেতমজুর, কারও হয়তো চায়ের দোকান রয়েছে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাদের নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। লকডাউনের কারণে উপার্জন বন্ধ। এ দিকে, গাড়ি ভাড়া করে কলকাতায় আসতে হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "শুধুমাত্র এই বিষয়টি নয়। রক্তের মারাত্মক সংকট চলছে। এই অবস্থায় বহু ক্ষেত্রে ডোনার না নিয়ে গেলে ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, COVID-19-এর সংক্রমণের আতঙ্কে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না। ডোনার কোনওভাবে যদিও জোগাড় করা যায়, তাঁকে এবং রোগীকে নিয়ে গাড়ি ভাড়া করে কলকাতায় রক্ত দিতে আসতে টাকা লাগছে।"
বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাকা জোগাড় করতেও পারছেন না অনেকে। এই অবস্থায় থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের বাঁচাতে জেলার ব্লাডব্যাঙ্কগুলিতে যাওয়ার জন্য তাঁদের অভিভাবকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সংগঠনের তরফে। তবে, এ ক্ষেত্রেও আশঙ্কা পিছু ছাড়ছে না। কারণ, লকডাউন শুরু হওয়ার পরে কলকাতায় আসতে না পেরে জেলাস্তরের এক ব্লাডব্যাঙ্কে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এক কিশোরীকে রক্ত দেওয়া হয়েছিল। ওই কিশোরীকে হোল ব্লাড দেওয়া হয়েছিল। তার পরে ওই কিশোরীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। কলকাতার এক হাসপাতালে আনা হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের অভিভাবকদের এই সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে, হোল ব্লাড দেওয়ার কারণে ওই কিশোরীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল।
গৌতম গুহ বলেন, "রক্তের মারাত্মক সংকট চলছে। ডোনারকে নিয়ে গিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করা, রোগীকে নিয়ে আসা, এক জনের রক্তের জন্য কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বাচ্চাদের কীভাবে বাঁচাবে, গরিব-সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে এটা এখন কঠিন সমস্যা।"
লকডাউনের ফলে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে রয়েছে। যে কারণে উপার্জনও বন্ধ। দিন আনি দিন খায় এমন অনেক পরিবারেও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে, যাদের ক্ষেত্রে নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন। থ্যালাসেমিক অভিভাবকদের ওই সেন্টারের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট বলেন, "এমনিতেই চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের অনেক পরিবার। তার উপর, লকডাউনের কারণে উপার্জন এখন বন্ধ। একদিকে রক্তের সংকট, অন্যদিকে অর্থনৈতিক এই সংকট, এর সঙ্গে রয়েছে COVID-19 সংক্রমণের আশঙ্কা। সবমিলিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে রক্তের জোগাড় হবে, কীভাবে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বাচ্চাদের বাঁচাতে পারবেন, এটা ছাড়া অন্য কিছু আর ভাবতে পারছেন না বহু অভিভাবক।"
তিনি বলেন, "জেলার অনেক নার্সিংহোমে নতুন রোগীকে ভর্তি নেওয়া হবে না বলেও এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাদের কলকাতায় নিয়ে আসতে হচ্ছে অনেক অভিভাবকে। এ দিকে, কলকাতায় আসার জন্য গাড়ি ভাড়া করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও অনেকের নেই। অনেকের কাছে খাবারও নেই।"
উত্তর কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের সম্পাদক ডি আশিস বলেন, "পশ্চিমবঙ্গেও COVID-19-এ আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এদিকে রক্তের সংকট চলছে। পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। থ্যালাসেমিয়ায় কোনও আক্রান্ত যে অঞ্চলে থাকে, আমরা সেই অঞ্চলের ডোনার খোঁজার চেষ্টা করছি। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তের পরিবারের সদস্যদেরও বোঝানো হচ্ছে, যাতে তাঁদের পরিচিতদের মধ্যে কোনও ডোনার তাঁরা খুঁজে পান।"
এই বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয়কুমার চক্রবর্তীর বক্তব্য জানতে চেয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে, তিনি ফোন না ধরায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।