হাওড়া, 3 মার্চ : পরশপাথরের ছোঁয়ায় লোহা সোনা হয়েছিল ৷ তবে সেই পরশপাথর ভাগ্য ফেরায়নি তুলসী চক্রবর্তীর । কৈলাশ বোস থার্ড বাই লেন । এই গলির নাম হয়তো অনেকেই শোনেননি কোনও দিন । তবে এই বাড়িতে যিনি বসবাস করেছেন আমৃত্যু । আজ শুধু তাঁর জন্মবার্ষিকীতেই যে মানুষ তাঁকে মনে করেন তা নয়, স্বমহিমায় তিনি সর্বদাই বিরাজ করছেন বাঙালির হৃদয়ে (Tulsi Chakraborty Birth Anniversary)।
তাঁকে উদ্ধৃত করে প্রখ্যাত চলচিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, "উনি হলিউডে জন্মালে এতদিনে অস্কার পেতেন ।" তবে এই পোড়ার দেশে অস্কার তো দূরে থাক জীবিতবস্থায় দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন সংস্থান করতে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে । নিদারুণ ঠান্ডায় এই শিল্পীর গরম পোশাক না থাকার খবর পেয়ে মহানায়ক উত্তমকুমার নিজে তাঁর অভিনয়ের স্টুডিওতে পৌঁছে একটি শাল তাঁকে পরিয়ে দিয়েছিলেন । ওই শাল পেয়ে নিজের আবেগকে ধরে রাখতে না পেরে উত্তমকে জড়িয়ে ছোট শিশুর মতো হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন ।
চিরকালের কৌতুক অভিনেতা রূপে তাঁর সাবলীল অভিনয় বাঙালিকে আজও মুগ্ধ করে । সেই উচ্চমার্গের অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি আজ দেখাশোনার অভাবে ভগ্নপ্রায় ৷ হাওড়ার 2 নম্বর কৈলাশ বোস থার্ড বাই লেনের এই বাড়িতে এখন সাপের বাস ৷ হাওড়া পৌরনিগমের তরফে শুধু সামনের মাঠটি তাঁর নামে নামাঙ্কিত করেই দায় সারা হয়েছে ৷ শিল্পীর প্রকৃত মর্যাদা মেলেনি ।
সদাহাস্য মানুষটি ছিলেন বাংলা চলচিত্র জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন । মধ্য হাওড়ার এই 2 নম্বর কৈলাশ বোস থার্ড বাই লেনের 6 ফুটের সরু গলি দিয়েই ছিল নিত্য যাতায়াত ৷ সারা জীবন কেটেছে দুঃখ-দৈন্যে ৷ শেষে স্ত্রীকেও রেখে গিয়েছিলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায় । শেষ সময়টা চেয়েচিন্তে খাবারের জোগাড় করতে হয়েছে তাঁকে ৷ রুপোলি পর্দায় ফর্মুলা ফলে গেলেও পরশপাথরের সেই ফর্মুলা বাস্তব জীবনে ফলাতে পারেননি প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা । দীপ জ্বেলে গেলেও রয়ে গেলেন প্রদীপের তলার অন্ধকারেই ।
তুলসী চক্রবর্তী (3 মার্চ, 1899 - 11 ডিসেম্বর, 1961) চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকের বাংলা সিনেমার একটি স্তম্ভ ছিলেন ৷ খ্যাতি লাভ করেন প্রধানত কমিক ভূমিকায় অভিনয় করে ৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল সত্যজিৎ রায়ের 'পরশপাথর' ৷
বাল্যকাল :
1899 সালের 3 মার্চ গোয়ারি নামক এক ছোট গ্রামে জন্ম ৷ বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী ছিলেন ভারতীয় রেলের কর্মী ৷ বাবার কাজের সূত্রে ছোটবেলা থেকেই অবিভক্ত বাংলার নানা জায়গায় ঘুরতে হয়েছে । তরুণ তুলসীকে কলকাতায় তাঁর কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে কিছুকাল থাকতে হয়েছিল । প্রসাদবাবু প্রখ্যাত স্টার থিয়েটার-এর এক জন বিশিষ্ট তবলা ও হারমোনিয়াম বাদক ছিলেন । কাকার যোগাযোগে তুলসী নিজের প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন ৷ সেখান থেকেই অভিনয় এবং সঙ্গীতের অনুপ্রেরণা পান ৷ পরবর্তীতে বাস্তবসম্মত অভিনেতা হিসাবে পরিচিতি পান । কোনও মেকআপ বা অতিরিক্ত আয়োজন না থাকাই ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক ৷ মূলত দেখা যেত কাঁধে একটি উপবীত ও পরনে একটি সাদা ধুতি ৷
কর্মজীবন :
উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় তুলসী চক্রবর্তী একটি লজিং-এর ম্যানেজার হিসাবে অনন্যসাধারণ নজির রাখেন ৷ বিপুল জনপ্রিয়তা আসে তারপরই ৷ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পরশপাথর’ চলচ্চিত্রে তাঁর প্রধান ভূমিকা চিরতরে দর্শকের মনে দাগ কেটেছে ৷ 'পথের পাঁচালী'তে তাঁকে পাঠশালার গুরুমশাইয়ের ছোট্ট ভূমিকায় দেখা যায় ৷ সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, "তুলসী চক্রবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে তাঁকে অভিনয় দক্ষতার জন্য অস্কার পুরস্কার প্রদান করা হতো ।"
2 নম্বর কৈলাশ বোস থার্ড বাই লেন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দাদের ইচ্ছা, বেশি কিছু সম্ভব না হলেও এমন গুণীজনের অন্তত একটা মূর্তি স্থাপন করা গেলে বেশ ভাল হতো ৷