দুর্গাপুর, 5 সেপ্টেম্বর: জন্মান্ধতা বাধা হতে পারেনি ৷ জীবনের সব ক্ষেত্রেই তিনি উত্তীর্ণ ৷ সঞ্জয় গোস্বামী আজ একজন সফল শিক্ষক ৷ জীবনে কখনও নিজেকে অসহায় ভাবতে শেখেননি ৷ জীবনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করাতেই বিশ্বাসী তিনি ৷
জন্মান্ধ শিশুপুত্র ৷ জন্মের পরে তার বাবা-মাকে শুনতে হয়েছিল, "এ ছেলে কী করবে? বামুনের ছেলে এই যা রক্ষে ! পৈতে ধরে পুজা-পাঠ করে পেট চালিয়ে নিতে পারবে ।" না পুজো-পাঠ করে শুধু চালিয়ে নিতে হয়নি ৷ আজ তিনি ছাত্র বানানোর কারিগর ৷ ১০০ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী জন্মান্ধ সেই ছেলেই আজ পানাগড় রেলওয়ে কলোনি স্কুলের বহু ছাত্র-ছাত্রীকে নিজে হাতে তৈরি করে চলেছেন । ইংরেজি শিক্ষক হলেন সঞ্জয় কুমার গোস্বামী । ঝড়, বৃষ্টি শত প্রতিকূলতারা মাঝেও সঞ্জয়ের অনুপস্থিতি স্কুলের ডায়েরিতে লেখা নেই । তাঁর মত একজন শিক্ষককে পেয়ে গর্বিত স্কুলের সমস্ত সহ কর্মী থেকে ছাত্রছাত্রীরা ।
জন্ম থেকেই দু চোখে দেখতে পান না সঞ্জয়বাবু । অনুপ্রাণিত করতে কেউ আসেনি বাবা মা ছাড়া ৷ বরং ছোটো থেকেই কপালে জুটেছে পাড়া-পড়শির ব্যঙ্গোক্তি ৷ কলকাতার ব্লাইন্ড স্কুল থেকে 1996 সালে মাধ্যমিক পাশ করেন ৷ 1998 সালে আসানসোলের কুলটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন ৷ এরপর আসানসোলের BB কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে 2001 সালে গ্রাজুয়েশন পাশ করেন তিনি । এরপর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে M.A ৷ 2005 সালে SSC পাশ করে পানাগরের রেলওয়ে কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক হন ৷ জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজের সেরাটা দিয়ে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত ৷ শুধু প্রতিষ্ঠিতই নন ৷ তিনি আজ শিক্ষক ৷ ছাত্র গড়ার কারিগর ৷ ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক ৷ সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি হার মানেননি । পেরেছেন প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে ৷ শুধু এইটুকুই ? স্কুলে হাজিরা নিয়মিত ৷ ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য নিজে বাড়িতে বসে কম্পিউটারে নোট তৈরি করেন ৷ তারপর তার প্রিন্ট আউট বের করে ছাত্র-ছাত্রীদের দেন ৷ তবে এরজন্য কম্পিউটারের বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয় তাঁকে ৷ যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও দায়িত্ব নেওয়াতেও তাঁর জুরি মেলা ভার ৷ স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাঁর উপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন ৷ কারণ শুধু পড়াশোনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি ৷ পাশাপাশি শিখেছেন গানও ৷ কয়েককবার প্রতিবন্ধী শিল্পী হিসেবে টেলিভিশনের পর্দায় অনুষ্ঠানও করেছেন ৷ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তাঁর এক অন্য জগৎ ৷ ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক দেখার মতো ৷ তাঁকে হাত ধরে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আবার স্কুল ছুটির পর একই ভাবে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে স্কুলের পড়ুয়ারাই ৷
সঞ্জয়বাবুকে একজন সহকর্মী হিসেবে পেয়ে গর্বিত স্কুলের প্রধান শিক্ষকও ৷ তাঁর কথায় , "সঞ্জয়বাবু একজন দৃষ্টান্ত ৷ এই স্কুলে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক সুদৃঢ় ও সুন্দর ৷ সম্প্রতি রাজ্যে ছাত্র-শিক্ষকের বিরোধ ঘটছে ৷ কিন্তু আমাদের স্কুল সবার থেকে আলাদা ৷ এখানে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক যতটা বন্ধুর মতো ততটাই শ্রদ্ধার ৷ সবার মধ্যে এই সম্পর্ক বজায় রাখতে পারলে কোনও সমস্যাই হবে না ৷"
স্কুলের পড়ুয়া মেঘনা দাস, জয়ত্রী দাস সবার কথাই এক৷ "উনি খুবই ভালো পড়ান ৷ অসুবিধা হলে বারবার বুঝিয়ে দেন ৷" স্কুলের এক শিক্ষিকা পলা গাঙ্গুলির কথায়," সঞ্জয় আমাদের কাছে বিস্ময়কর ৷ আমরা তো ওনাকে চলন্ত কম্পিউটার বলে ডাকি ৷ ওনার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ৷ যখনই কোনও সাহায্যের দরকার হয়েছে কোনওদিন না করেননি ৷"
নিজের জীবনে কখনও আলো দেখতে পাননি সঞ্জয়বাবু ৷ কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের জীবনকে আলোকিত করতে কখনও পিছপা হন না এই মানুষটি ৷ সকল ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা, " দৃষ্টিহীনতা আমার কাছে কোনও সমস্যাই নয় ৷ কারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা ও সহযোগীতা আমার সব সমস্যা কাটিয়ে দেয় ৷ "