এরপর যখন আপনি থিয়েটারে যাবেন, তখন মনে হতেই পারে একটা সাই-ফাই ছবির দৃশ্যের মতো । আপনার টিকিটের জায়গা নেবে মোবাইলে QR কোড; হাতে ধরা মেটাল ডিটেক্টরের জায়গা নিয়ে নেবে ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর, যা বিমানবন্দরে ব্যবহার হয়; খাবারের স্টলে যে পরিবেশকরা থাকবেন, তাঁদের এবং গ্রাহকদের মধ্যে থাকবে একটা পার্সপেক্স কাঁচ; প্রেক্ষাগৃহে থাকবে ক্লাস্টারভিত্তিক বসার ব্যবস্থা, যেখানে মার্কার দিয়ে যথাযথ সামাজিক দূরত্ব চিহ্নিত করা থাকবে । আর অবশ্যই প্রত্যেককে তাঁদের নিজেদের স্যানিটাইজার এবং ফেস মাস্ক সঙ্গে রাখতে হবে এবং থ্রি-ডি ছবি দেখতে হলে নিজেদের থ্রি-ডি গ্লাস কিনতে হবে ।
নতুন পৃথিবীর সিনেমা দেখতে যাওয়ায় আপনাকে স্বাগত, যা আশানুরূপভাবে 15 জুন থেকে 15 জুলাইয়ের মধ্যে যে কোনও সময় ঘটতে পারে । সামনেই অপেক্ষা রয়েছে বড় ছবিগুলির মুক্তি, যেমন অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগণ ও রণবীর সিং অভিনীত রোহিত শেট্টির 135 কোটি টাকার ‘সূর্যবংশী’, কবীর খানের 125 কোটির ‘83’, যেখানে কপিল দেবের ভূমিকায় রয়েছেন রণবীর সিং, 100 কোটির ‘রাধে: ইওর মোস্ট ওয়ান্টে়ড ভাই’ যেখানে রয়েছেন সলমন খান, তাই বলিউডের আর অপেক্ষার সময় নেই । কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এতটাই অধৈর্য হয়ে পড়েছেন যে তাঁরা সোজা অনলাইনে ছবির মুক্তি করতে চান । এর তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে আইনক্স লেজারের পক্ষ থেকে, যাঁদের দেশজুড়ে 620টিরও বেশি স্ক্রিন রয়েছে । অনলাইনে বা ওটিটিতে গ্লোবাল প্রিমিয়ারের আন্দোলন শুরু করেছে যে ছবি, সেই ‘গুলাবো সিতাবো’-র প্রযোজককে ‘ভালো সময়ের বন্ধু’ আখ্যা দিয়ে একটি বিবৃতিতে ‘ন্যায়বিচার’-এর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে । একইরকম আগ্রাসীভাবে জবাব দিয়েছে প্রোডিউসার্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া । তাঁরা এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বিনিয়োগে সুদ বেড়ে চলা, বিমার অভাব, সিনেমা হল খোলায় অনিশ্চয়তা, এবং পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত সেটের জন্য বিপুল খরচের কথা তুলে ধরেছেন ।
দেশজুড়ে 9000 স্ক্রিনের মধ্যে 850টি নিয়ন্ত্রণ করে যারা, সেই PVR-এর চেয়ারম্যান ও এমডি অজয় বিজলি এই যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকার করেছেন । তিনি বলছেন সিনেমার ম্যাজিকের কথা । কোনও প্রযোজকই যে বড় পর্দায় অভিজ্ঞতার বিনিময়ে স্ট্রিমিং সার্ভিস চান না, সেটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা একটা বিচ্যুতি, কোনও কাঠামোগত পরিবর্তন নয় ।” তিনি বলেন, ছবি থেকে 45 শতাংশ আয় এখনও সিনেমাহল থেকেই আসে, বাকিটা ভাগাভাগি হয় ব্রডকাস্ট এবং ডিজিটাল রাইটের মধ্যে ৷
বক্স অফিস এখনও রাজা, কিন্তু বহু চলচ্চিত্রনির্মাতা মনে করেন, যে বড় পর্দার জন্য ছোট ছবি তৈরির করার সময় এসে গেছে । কোরোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে বড়পর্দার জন্য বড় সিনেমা, তার সঙ্গে ডাবিং করা হলিউডি ছবি যা সামগ্রিক ভারতীয় বক্স অফিসের দশ শতাংশ দখল করবে এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ছোট ছবি ও লম্বা সিরিজগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি হবে । অনু মেননের কথাই ধরুন । তিনি অ্যামাজন প্রাইমে ‘ ফোর মোর শটস প্লিজ’-এর প্রথম সিজনের পরিচালক ছিলেন । তিনি বিদ্যা বালন অভিনীত ‘শকুন্তলা দেবী’-রও পরিচালক, যা বড় পর্দার জন্য তৈরি হলেও মুক্তি পেতে চলেছে অ্যামাজন প্রাইমে (পাশাপাশি রয়েছে তারকা অভিনেত্রীদের অভিনীত একগুচ্ছ আঞ্চলিক ছবিও, যেমন কীর্তি সুরেশের ‘পেঙ্গুইন’, জ্যোতিকার ‘পোঙ্গামল ভানধাল’ এবং অদিতি রাও হায়দারির ‘সুফিয়াম সুজাতায়ুম’) । অনু বলেন, “একটা সিরিজ এবং একটি ছবিতে গল্প বলার ছন্দটা পুরোপুরি আলাদা । কিন্তু আমি একজন গল্পকথক । যাই মাধ্যম হোক না কেন, আমি শুধু ভাবি কীভাবে সবথেকে ভালোভাবে গল্পটা বলা যায় ।” এই কঠিন সময়েও তাঁর ছবি দুশোটি দেশে বিপুল সংখ্যায় দর্শকের কাছে পৌঁছবে, সেটা ভেবে তিনি উত্তেজিত । তাঁর কথায়, “এই ছবি এমন এক মহিলাকে নিয়ে যিনি জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বাঁচতে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন । এটি একজন মা ও মেয়ের সুন্দর একটি কাহিনি, এমন কাহিনি যা মানুষ তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখতে চাইবেন ।”
অন্য একটি বড় প্রশ্নটি হল, শুটিং কখন শুরু হবে, এবং কীভাবে । নিশ্চিতভাবেই সেখানে পরিচ্ছন্নতা থাকতে হবে এবং অভিনেতা ও কলাকুশলীদের রক্ষা করতে যাবতীয় নিরাপত্তাবিধিগুলো মেনে চলা হবে । বহু ছবি রয়েছে যা প্রায় সম্পূর্ণ, অর্ধেক শুট সম্পূর্ণ অথবা সবে শুরু হতে চলেছে । ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর রিমেক, আমির খান অভিনীত ‘লাল সিং চাড্ডা’ যিনি পরিচালনা করছেন, সেই অদ্বৈত চন্দন জানালেন, যে শুটিং ভালই চলছিল । কার্গিল যুদ্ধের একটি সেটপিস এবং মুম্বই ও দিল্লিতে কয়েকদিনের বাকি রয়েছে । ডিসেম্বরে মুক্তির লক্ষ্য পূরণ হবে বলেই তাঁর আশা, যদিও এখনও VFX বহু কাজ বাকি রয়ে গেছে । একটি কাশ্মীরি পরিবারের তিন প্রজন্মকে নিয়ে দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় নেটফ্লিক্সের জন্য যে ছবি তৈরি করছিলেন, তার একদিনের শুটিং বাকি আছে । তরুণ প্রেম নিয়ে অনুরাগ কাশ্যপের ছবির শ্যুটিং বাকি চারদিন । তাঁরা সবাই ফিরে আসার অপেক্ষায় । কাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছেন করন জোহরও, যিনি তাঁর মুঘল এপিক ‘তখত’-এর জন্য 250 কোটি টাকা খরচ করে মুম্বইয়ে দুটি সেট তৈরি করিয়েছেন ।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবই পরিবর্তনশীল এবং চলচ্চিত্র শিল্প অন্তত পাঁচ মিলিয়ন মানুষের পরোক্ষ কর্মসংস্থান জোগালেও, তা কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলোর অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই । বহু সিনেমা হল রয়েছে মলের মধ্যে, যা সিনেমা দেখতে যাওয়াকে আরও একদফা বিপজ্জনক করে তুলেছে । অ্যামেরিকায় পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান মনে করেন যে, 17 জুলাই তাঁর বহু প্রতীক্ষিত ‘টেনেট’-এর মুক্তি মানুষকে আবার হলমুখী করবে, কিন্তু চলচ্চিত্রশিল্পকে কাজ করতে হবে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে । অ্যামেরিকায় চারটি প্রধান স্টুডিও এবং বড় প্রদর্শক-চেইন রয়েছে । সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে এখানে কেবল কয়েকটা ফোন কলের প্রয়োজন । ছবিটা ভারতের মতো নয়, যেখানে প্রযোজকরা অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন এবং ছবির সংখ্যাও অনেক বেশি - বছরে 1000 থেকে 1200-র মধ্যে, যেখানে আমেরিকায় সংখ্যাটা 200 ।
তবে এতে এটাও বোঝায়, যে ছবি দেখার খিদেও এখানে অনেক বেশি । একটা সামান্য ভাইরাস কি তা ধ্বংস করতে পারে?