অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য সেরা ওষুধ
ছোট হোক বা বড়, সাধারণ বা জটিল রোগ, কোনও না কোনও ভাবে দেশের অসংখ্য অসুস্থ মানুষের জন্য এ বার সুখবর । শোনা যাচ্ছে, দেশের ওষুধ শিল্পে বড়সড় বিপ্লব আসতে চলেছে । কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ পদক্ষেপে এক ধাক্কায় প্রায় 80 শতাংশ কমতে চলেছে ওষুধের দাম ।
সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে প্রায় 10 হাজার অনথিভুক্ত ওষুধের শ্রেণি রয়েছে, যেগুলির দামের উপর সেন্ট্রাল ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া বা ভারত সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই । এই 10 হাজারের মধ্যে যেমন রয়েছে বিভিন্ন ভিটামিন ওষুধ, তেমনই রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক । ওষুধের উপর সর্বোচ্চ 30 শতাংশ লাভের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেছে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা এবং বিক্রেতারা । ক্যানসারের মতো ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসায় বিক্রেতারা ওষুধের উপর প্রায় 30 শতাংশ লাভ করেন ।
ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিকাল প্রাইসিং অথরিটি (NPPA) দামি ওষুধগুলোর উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় এই সব ওষুধের অন্য বৈচিত্রের চাহিদা বাড়ছে । স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক, NPPA এবং ভারত সরকারের মিলিত প্রচেষ্টার ফসল, সাধারণ ওষুধের বিভিন্ন শ্রেণিতে চড়া দামে রাশ পরানো সম্ভব হয়েছে । সরকার থেকে চলতি বছরের গোড়ায় একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়, বিরল রোগগুলির ক্ষেত্রে পেটেন্ট নেওয়া ওষুধগুলো বাজারে আসার প্রথম পাঁচ বছর নিয়ন্ত্রক মূল্যের আওতায় পড়বে না । ওষুধ বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের মত, পেটেন্ট নেওয়া ওষুধের ক্ষেত্রে মূল্য নিয়ন্ত্রণ অপরাধ । ক্রেতারা তখনই লাভবান হবেন, যখন ওষুধের দাম কমাতে সরকার কোনও শর্ত ছাড়া কিছু আর্থিক অবদান রাখবে ।
বাজারে এখন ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ি । এই ভেজাল ওষুধের রমরমা জীবনদায়ী থেকে শুরু করে খুব প্রয়োজনীয় ওষুধকেও রেয়াত করছে না । শুধুমাত্র জাল ওষুধের জন্য ম্যালেরিয়া ও নিউমোনিয়ায় ফি বছর বিশ্ব জুড়ে 25 লাখ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে । 2008 সালে 75টি দেশ থেকে মোট 29 রকমের জাল ওষুধ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে । এই সংখ্যা গত 10 বছরে লাফিয়ে বেড়েছে অনেকটাই । শুনতে অবাক লাগলেও এই সময়ে 113টি দেশ থেকে 75 রকমের জাল ওষুধের খোঁজ মিলেছে । সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই জাল ওষুধের একটা বড় অংশের কারবার হয় চিন ও ভারতে । জাল ওষুধের কারবারে যুক্ত দোষীদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে 15 বছর পর্যন্ত জেলের সাজা দেওয়া হয় ।
জাল ওষুধের কারবারিদের জন্য ওষুধে আসক্ত করার মতো ব্যবসার ভালো পরিবেশ আর হতে পারে না । শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতালেই 11 শতাংশ ওষুধ গুণমানের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় । চার বছর আগে ASSOCHAM (দ্য অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অফ কমার্স অফ ইন্ডিয়া) জানিয়েছিল দেশে 30 হাজার কোটি টাকার জাল ওষুধের কারবার হয় । এমনকি, বহু আগে মাশেলকর কমিটি জানিয়েছিল, ধাপে ধাপে কীভাবে এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা যায় ।
এই ধরনের জাল ব্যবসা সম্বন্ধে জানার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা না নেওয়া এই জাল ওষুধের ব্যবসার রমরমার অন্যতম কারণ । গত কয়েক বছরে জাল ওষুধের কারবার রুখতে ব্লক চেন প্রযুক্তি কিছুটা সাহায্য করেছে । তবে, আর দেরি করা উচিত নয় । অবিলম্বে এই ধরনের বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে জাল ওষুধের কারবারকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে । একটা সরকারি প্রকল্প এবং অ্যাকশান প্ল্যান অবিলম্বে চালু করতে হবে, যাতে দেশের ওষুধ শিল্প এবং সর্বোপরি এর সঙ্গে যুক্ত দেশের কোটি কোটি গ্রাহক নিরাপদ থাকতে পারে, সুস্থ ভাবে জীবন কাটাতে পারে ।
দেশে যদি জেনেরিক ওষুধকে জনপ্রিয় করা সম্ভব হত, তা হলে এর থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতেন দেশের গরিব মানুষরা । জেনেরিক ওষুধের দোকানগুলিতে যে বেশ কম দামে ওষুধ পাওয়া যায়, সে কথা অনেকেই জানেন । সরকারি সূত্র বলছে, দেশে পাঁচ হাজারেরও বেশি জেনেরিক ওষুধের দোকান রয়েছে । কিন্তু দুঃখের কথা হল, সরকারি ঘোষণা এবং বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্যটা কয়েক আলোকবর্ষের । সমীক্ষা বলছে, অ্যামেরিকার তিন চতুর্থাংশ চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধের নাম লেখেন । ব্রিটেনের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরও বেশি । আরও চমকে দেওয়া তথ্য হচ্ছে, ভারত বিশ্বের এক নম্বর জেনেরিক ওষুধ প্রস্তুতকারক । দেশের 30 শতাংশ ওষুধ অ্যামেরিকায় রপ্তানি করা হয়, আফ্রিকায় যায় 19 শতাংশ, ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে যায় 16 শতাংশ । এছাড়া, রাশিয়া, নাইজেরিয়া, ব্রাজ়িল, জার্মানিতেও রপ্তানি করা হয় ওষুধ । দেশের বাজারে জেনেরিক ওষুধের জনপ্রিয় না হয়ে ওঠার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওষুধের মান ও ব্যবহার নিয়ে মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিপথে চালিত করা হয় । এর ফলে উপকৃত হয় একদল স্বার্থান্বেষী চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও হাসপাতাল ।
নয়াদিল্লির চারটি প্রধান ক্লিনিক নিয়ে করা সমীক্ষার একটি রিপোর্টে NPPA জানাচ্ছে, এই সব ক্লিনিক গ্রাহকদের থেকে কমদামি ওষুধের থেকে 160-1200 শতাংশ এবং অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ থেকে 115-360 শতাংশ পর্যন্ত লাভ করছে । বছরের পর বছর ধরে দেশ জুড়ে চলে আসা এই ধরনের প্রতারণার জন্য বহু মানুষ শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত হারিয়েছেন ।
আমাদের মতো দেশে, যেখানে চিকিৎসা খরচের 70 শতাংশ খরচ হয় শুধুমাত্র ওষুধের জন্য, সেখানে জেনেরিক ওষুধকে আম জনতার কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতেই হবে । সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বেসরকারিভাবে তৈরি হওয়া ওষুধের দামকে । এই ভাবে জাল ওষুধের কারবারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে হাতে হাত রেখে কাজ করতে হবে । এই ভাবেই সবার কাছে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার অধিকার পৌঁছে দিতে হবে । আর এই ভাবে আমরা গড়ে তুলতে পারব এক শক্তিশালী ও সুস্থ রাষ্ট্রের ।