সকল পিতামাতাকে সম্মান জানিয়ে জুলাইয়ের চতুর্থ রবিবার পিতামাতা দিবস পালিত হয় । আমাদের বাবা-মা যেখানেই থাকুক না কেন, এই দিনে জীবনে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উদযাপন করি । মে মাসে আমরা মাতৃ দিবস উদযাপন করি এবং জুনে আমরা ফাদারস ডে উদযাপন করি । আর তা অনুসরণ করেই জুলাইয়ে সমস্ত অভিভাবকদের একত্রিত করতে এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পিতামাতা দিবস পালিত হয় ।
শিশুর জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তার বাবা-মা । জন্ম থেকে, বাবা-মা রোল মডেল হিসেবে সুরক্ষা, শিক্ষা সবকিছুই নিশ্চিতভাবে দিয়ে থাকেন । একটি পরিবারের অংশ হিসেবে, আমরা তাঁদের দিকনির্দেশনাতেই চলি । তাঁদের অনুসরণ করেই আমরা সমাজের একটি মূল অংশ হয়ে উঠি । সমগ্র জীবন জুড়ে, অভিভাবকরাই আমাদের স্বাধীন চিন্তা করতে শেখান । আমরা অনেকেই জানি, এই প্রচেষ্টা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে । কারণ, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়েই নানা পরিবর্তন হচ্ছে । তাই এই বিশেষ রবিবার, সকল পিতামাতাদের সম্মান জানানো হয়, যারা সন্তানের লালনপালন এবং সুরক্ষার জন্য সবকিছু করেন । প্রতি বছর, জুলাই মাসের চতুর্থ রবিবারটি পিতামাতা দিবস হিসেবে পালিত হয় ।
পিতামাতা দিবসের ইতিহাস :
পিতামাতা দিবস এই বার্তাই প্রচার করে যে, একটি শিশুর বিকাশে পিতামাতার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য বিনিয়োগ, ত্যাগ এবং প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন । 1994 সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন আইনের মাধ্যমে অ্যামেরিকান কংগ্রেস দ্বারা গৃহীত একটি প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন যার মাধ্যমে প্রতিবছর জুলাইয়ের চতুর্থ রবিবার পিতামাতা দিবস হিসেবে গৃহীত হয় । এই দিনটির ভূমিকা ও গুরুত্ব ফাদারস ডে ও মাদারস ডে-র সমান । অ্যামেরিকান কংগ্রেসের রেজ়লিউশন অনুযায়ী, "সন্তানের লালনপালনে বাবা-মা'র ভূমিকার স্বীকৃতি, উন্নতি এবং সমর্থন করার জন্য" দিবসটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
পিতামাতা দিবসের গুরুত্ব :
দিবসটি বিশ্বজুড়ে সকল পিতামাতাকে উৎসর্গ করে, এবং পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য ও তাঁদের সুখ, ভালোবাসা এবং বোঝার পরিবেশ তৈরির জন্য তাঁদের প্রতিশ্রুতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একটি উপলক্ষ্যে । প্রত্যেক অভিভাবকই নিজেদের সহজাত শক্তি এবং প্রতিভা অনুযায়ী তাঁদের সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠন এবং নৈতিক মূল্যবোধ ও জীবনযাপনে চেতনা দান করেন । ‘প্যারেন্টস ডে’ শিশুদের জীবনে পিতামাতার উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দেয় । বাবা-মায়েদের ত্যাগ, লালন ও যত্ন, সংবেদনশীল মনোভাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয় । কেবলমাত্র শিশুর যাবতীয় চাহিদাপূরণই নয়, অভিভাবকরা গাইড এবং পরামর্শদাতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যা তাঁদের সন্তানের আচরণের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে । প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর অন্য কোনও সম্পর্কই পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের ধারেকেছেও আসে না । সন্তানের সঙ্গে তার বাবা-মায়ের এই সম্পর্কই পারিবারিক বন্ধনকে পুষ্ট ও দৃঢ় করে এবং আজীবন ধরে রাখে ।
অন্য দেশে পিতামাতা দিবস উদযাপন :
সন্তানের জীবনে পিতামাতার ইতিবাচক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকে স্বীকৃতি দিতে কার্ড এবং উপহার দেওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত দিন হল এটি । এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য, শিশুরা প্রায়শই ব্যক্তিগতভাবে উপহার দেয় যেমন পারিবারিক ছবি, কোলাজ, স্টিকার এবং স্কেচ এমনকী হাতে বানানো স্কার্ফ, বক্স এবং 'ধন্যবাদ' জানানোর অন্য যে কোনও স্নেহময় উপায় যা তারা কল্পনা করতে পারে । দিবসটি উদযাপনের খুব মজাদার কিছু উপায় :
অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে অংশ নেওয়া
পারিবারিক পিকনিকের আয়োজন
রাতে বাইরে খেতে যাওয়া
একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়া
ভাউচার উপহার দেওয়া
একসঙ্গে ঘর পরিষ্কার করা বা ঘরের অন্যান্য কাজ করা
বিভিন্ন ফাউন্ডেশন এবং সোসাইটি দ্বারা আয়োজিত বক্তৃতা, বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান বা গির্জায় পারিবারিক বন্ধনকে জোরদার করে এমন মজাদার ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্যে স্থানীয় সামাজিক ইভেন্টগুলির মাধ্যমেও এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয় । অ্যামেরিকায় প্রতিটি রাজ্য এমন এক বাবা-মা'কে মনোনীত করে যারা ভালো অভিভাবকত্বের জন্য ন্যাশনাল প্যারেন্টস অফ দা ইয়ার অ্যাওয়ার্ডের দাবি রাখেন ।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতীয় বাবা-মায়েরা অন্য দেশের চেয়ে তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন : বিশ্বব্যাপী এক-চতুর্থাংশ বাবা-মা সপ্তাহে সাত বা তার বেশি ঘণ্টা তাঁদের বাচ্চাদের পড়াশোনা করতে সহায়তা করে, এটি কলম্বিয়ায় 39%, ভিয়েতনামে 50% এবং ভারতে 62% । তবে উন্নত অর্থনীতিতে এই পড়াশোনায় সাহায্যের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে । শুধুমাত্র অ্যামেরিকায় 11%, ফ্রান্স এবং জাপানে 10% এবং ফিনল্যান্ডে 5% অভিভাবক বিদ্যালয়ের পরে বাচ্চাদের পড়াশোনায় সহায়তা করেন । ভারতীয় বাবা-মায়েরা সপ্তাহে গড়ে 12 ঘণ্টা বাড়ির কাজকর্মের জন্য ব্যয় করেন, এবং ভিয়েতনামের পিতামাতারা 10.2 ঘণ্টা সময় দেন । এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে তুর্কি অভিভাবক, যারা স্কুলের পর বাচ্চাদের পড়াশোনায় 7 ঘণ্টা ব্যয় করে । স্কুলের পরে শিশুদের পড়াশোনায় অভিভাবকদের সহায়তার হার বিশ্বজুড়ে সপ্তাহে গড়ে 6.7 ঘণ্টা যেখানে আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলির অভিভাবকরা এই গড় সময়ের কিছু বেশি সময় ব্যয় করেন । অ্যামেরিকা এবং পোল্যান্ডের পিতামাতারা প্রত্যেকে 2.2 ঘণ্টা করে, ব্রিটেনে যারা 3.3 ঘণ্টা করে সময় দেন । ফিনল্যান্ডের পিতামাতারা প্রতি সপ্তাহে 3.1 ঘণ্টা এবং জাপানি বাবা-মায়েরা 2.6 ঘণ্টা করে সহায়তা করেন ।
সন্তানের জন্য অভিভাবকরা কতদূর যেতে পারেন তার কয়েকটি উদাহরণ :
1. জ্বালামুখীর গুম্মার গ্রামের দরিদ্র বাবা-মা কুলদীপ কুমার ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের দুই সন্তানের অনলাইন পড়াশুনার জন্য স্মার্টফোন কিনতে আয়ের একমাত্র উৎস, তাঁদের গোরুটি 6,000 টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন । মার্চে লকডাউন কার্যকর হওয়ার পরই স্কুলগুলিও বন্ধ হয়ে যায় । তাঁর বাচ্চারা, আনু এবং ডিপ্পু যথাক্রমে ক্লাস IV এবং II-এ পড়ে । ক্লাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্মার্টফোন কিনতে চাপ দেওয়া হয়েছিল স্কুলের তরফে । মাটির বাড়িতে থাকা কুলদীপ কুমারের না আছে কোনও BPL কার্ড, না তিনি সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচির (IRDP) কোনও সুবিধা পান । কুলদীপ জানান, বাড়ি নির্মাণ ও আইআরডিপি, BPL এবং অন্ত্যোদয়ের মধ্যে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আর্থিক সহায়তার জন্য তিনি পঞ্চায়েতের কাছে বেশ কয়েকটি আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সব বৃথা হয় ।
2. লকডাউনের কারণে অন্ধ্রপ্রদেশে আটকে থাকা ছেলেকে ফেরাতে তেলাঙ্গানার নিজ়ামাবাদ জেলার এক 50 বছর বয়সি মহিলা 700 কিলোমিটার দূরে নেল্লোরে স্কুটি চালিয়ে আসেন । নিজ়ামাবাদ জেলার বোধন শহরের সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা রাজ়িয়া বেগম সোমবার সকালে নিজের স্কুটিতে যাত্রা শুরু করে মঙ্গলবার বিকেলে অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোর শহরে পৌঁছে তাঁর 17 বছরের ছেলে মহম্মদ নিজ়ামুদ্দিনকে ফিরিয়ে আনেন । তিনি তিনদিনের মধ্যে মোট 1,400 কিলোমিটার যাত্রা করেন ।
3. লকডাউনের 50তম দিনে আগ্রা হাইওয়ের উপর একটি দৃশ্য অনেকের চোখেই জল এনেছিল । পঞ্জাব থেকে 800 কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রার দুই-তৃতীয়াংশ হেঁটে এসে অবসন্ন এক মহিলা উত্তরপ্রদেশের আগ্রা হাইওয়ে দিয়ে নিজের সুটকেসটি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন । আর ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে সেই সুটকেসের ওপরই ঘুমোচ্ছে তাঁর 4-5 বছরের ছেলে ।
তবে ইদানিং বয়স্কদের যত্ন নেওয়া সন্তানদের কাছে একটি বোঝা :
একটি সমীক্ষা বলছে, কমপক্ষে 35% বয়স্কদের দেখাশোনা করে 'কখনওই' খুশি হন না । 62% ছেলে, 26% পুত্রবধূ এবং 23% মেয়ে প্রবীণদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য আর্থিক ভার বহন করেন । বয়স্কদের দেখাশোনা করার জন্য গড়ে একটি পরিবার গড়ে 4125 টাকা ব্যয় করে । 25.7% বয়স্কদের দেখভাল করতে ক্লান্ত এবং হতাশ বোধ করেন যা প্রবীণদের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণের ফলস্বরূপ প্রকাশ পায় ।