আনলক 2 চলছে ভারত, কিন্তু পুষ্টির ওপর কোভিড-19 মহামারীর প্রভাব আগামী বছরগুলোতে অনুভূত হবে । কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে পুষ্টি পরিষেবা লকডাউনের সময় (24 মার্চ থেকে 31 মে) ধাক্কা খেয়েছে এবং তা এখনও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি । পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব সম্ভবত কয়েকটি গোষ্ঠীকে অন্যদের থেকে বেশি আঘাত করবে, যেমন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এবং দু’বছরের কমবয়সী শিশুরা । এই বয়েসের ব্যবধান সারাজীবনের সমস্যা তৈরি করতে পারে যেমন মানসিক অক্ষমতা, দুর্বল স্বাস্থ্য এবং অ্যানিমিয়া।
ভারত সরকারের ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (ICDS) একটা মুখ্য কর্মসূচি, যার লক্ষ্য শিশুদের বিকাশের সময় ন্যূনতম শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ব্যবস্থা করা । সমস্ত গ্রামে থাকা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মাধ্যমে এই কর্মসূচি রূপায়ন করা হয়, যা চালান অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং সহায়করা । জুন 2019 পর্যন্ত ভারতের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সংখ্যা 13.78 লাখ, 13.21 লাখ কর্মী এবং 11.82 লাখ সহায়ক রয়েছেন ।
45 বছরেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর থাকার পর এই প্রকল্প ভারতের পুষ্টি উদ্যোগের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে । সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইনিশিয়েটিভে আমরা প্রায় দশক ধরে এই প্রকল্পের অগ্রগতির ওপর নজর রেখেছি এবং দেখেছি যে মহামারীর আগে থেকেই উদ্বেগের জায়গা ছিল । কোভিড-19 সংকট এগুলোকে গভীরতর করেছে।
প্রথম চ্যালেঞ্জ হল অপর্যাপ্ত কভারেজ । ICDS একটা সার্বিক প্রকল্প, যার অর্থ, প্রয়োজনে সমস্ত অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এবং শিশু (6 মাস থেকে 6 বছর বয়সী) এই পরিষেবা পাওয়ার অধিকারী ।
জুন 2019 পর্যন্ত, প্রায় 8.36 কোটি মানুষ রান্না করা খাবার বা রেশনের মাধ্যমে ICDS থেকে সহায়ক পুষ্টি পেয়েছেন । এই সংখ্যাটাকে বিরাট মনে হলেও, যদি আমরা পুষ্টি পাওয়া উচিত এমন শিশুদের সংখ্যা (6 মাস থেকে 6 বছর) এবং যারা পেয়েছে তাদের সংখ্যার তুলনা করি, তাহলে একটা বিরাট ফারাক থেকে যাচ্ছে । 2019 সালে 21 টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে, যোগ্য শিশুদের অর্ধেকেরও কম ICDS-এর মাধ্যমে সহায়ক পুষ্টি পেয়েছে ।
এরসঙ্গে আরও একটি দেখার বিষয় হল, যারা সহায়ক পুষ্টি পাচ্ছেন, তাঁরা সেটা গ্রহণ করছেন কিনা তা নিশ্চিত করা । উদাহরণস্বরূপ, বাড়ি নিয়ে যাওয়া রেশন প্রায়ই গোটা পরিবারের মধ্যে ভাগ হয়, বিশেষ করে যেগুলো অন্তঃসত্ত্বা এবং সদ্য মা হওয়া মহিলাদের পাওয়ার কথা ছিল । এর অর্থ, প্রকল্পের উদ্দেশ্য অনুযায়ী তাঁরা পুষ্টি পাচ্ছেন না ।
মহামারী এবং লকডাউনের জেরে, ভাইরাস ছড়ানো আটকাতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয় । বিরাট সংখ্যায় পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফেরার পর আরও বেশি পরিবারকে পুষ্টি এবং অদূর ভবিষ্যতে ন্যূনতম শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে । অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলোকেও নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য বিধি মানতে হবে, যার জন্য সময় লাগবে । এছাড়াও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত এবং নগদের জোগান কমে যাওয়ার ফলে দৈনিক খাদ্যের চাহিদা মেটানোও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে । অন্তঃসত্ত্বা এবং স্তন্যদায়িনী মায়েদের জন্য পুষ্টিমাত্রা বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ৷
এছাড়াও, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলো অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং অন্যান্য কর্মীদের ওপর ভরসা করে । কাউন্সেলিং, মায়েদের যত্ন, শিশুশিক্ষা ইত্যাদি তাঁদেরই দায়িত্বে । দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমান ICDS গাইডলাইনের আওতায় যেহেতু তাঁদের স্বেচ্ছাসেবক এবং ঠিকা শ্রমিক হিসেবে তালিকাভূক্ত করা আছে, তাঁরা কোনও নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক পান না । তাঁরা একটা সাম্মানিক পান যা বেশিরভাগ রাজ্যে দক্ষ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির থেকেও কম । আট বছরের তফাতে, ২০১৮-র অক্টোবরে এই সাম্মানিক অর্থের পরিমাণ 3000 টাকা থেকে বেড়ে 4500 টাকা হয় কর্মীদের জন্য, আর 1500 টাকা থেকে 2250 টাকা হয় সহায়কদের জন্য । এই বৃদ্ধি সত্ত্বেও তাঁদের পারিশ্রমিক ভীষণভাবে কম । এমন বহু উদাহরণ আছে, যেখানে এই টাকাটাও সময়ে দেওয়া হয় না – যার জেরে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের মতো অনেক রাজ্যে ধর্মঘটও হয়েছে ।
কোভিড-19-এর সময়ে এই কোরোনা যোদ্ধারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতার প্রসার এবং সমীক্ষা চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন । কেন্দ্র সরকারের কোভিড-19 নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা অনুযায়ী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উপসর্গের প্রাথমিক স্ক্রিনিং করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । তা সত্ত্বেও, যখন আমরা তাঁদের অভিজ্ঞতা জানতে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি, তাঁদের নিজেদের কাজ এবং কোরোনা সম্পর্কিত কাজ দুটোই করতে হয়, এবং তাঁদের কাছে এইসব কাজ করার উপকরণও নেই। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের পক্ষে পুষ্টি ও শিশুশিক্ষার দিকে নজর দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে । পাশাপাশি যেখানে রাজ্যের আয় কম, সেখানে খরচ অন্যান্য আপৎকালীন প্রয়োজন যেমন হাসপাতালের বেড, নিরাপত্তা উপকরণ, রেশন ইত্যাদির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার বিপদ রয়েছে, যেখানে সামনে থেকে লড়াই করা কর্মীরা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
তাহলে কী করা যেতে পারে?
ভারতে যেখানে পাঁচ বছরের নিচে 68 শতাংশ শিশুর মৃত্যু অপুষ্টির কারণে হয়, যেখানে লকডাউন ও মহামারীর জেরে পরিষেবার বিঘ্নের প্রভাব সেইসব শিশুদের জন্য সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যারা এইসময় জন্মেছে । এটা দেখে ভালো লাগছে যে বহু রাজ্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে নথিভূক্ত মানুষদের জন্য রান্না করা খাবারের বদলে শুকনো রেশন দেওয়ার ঘোষণা করেছে । যদিও, কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে :
প্রথমত, আগে নথিভূক্ত সুবিধাভোগীদের থেকেও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে । তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে সরকার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের নিয়মিত সমীক্ষার মাধ্যমে, সেইসব মানুষদের সংখ্যার পূনর্মূল্যায়ন করুক, যাদের এইসব পরিষেবা পাওয়া দরকার । কেউ যাতে বাদ না পড়েন, তা নিশ্চিত করতে কোভিড-19 নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচার অভিযানকে কাজে লাগানো যেতে পারে ।
দ্বিতীয়ত, নিশ্চিত করতে হবে যাতে সহায়ক পুষ্টি অন্তঃসত্ত্বা মহিলা ও শিশুদের কাছে পৌঁছায় এবং যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানো যায় । ওড়িশায় যেভাবে বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছানো হচ্ছে, সেভাবে করা যেতে পারে । ঝাড়খণ্ডের মতো কয়েকটি রাজ্য বার বার সংস্পর্শে আসা এড়াতে বেশ কয়েকমাসের রেশন একবারে দিয়ে দিয়েছে । যদিও বাড়িতে কতটা মজুত রাখার জায়গা আছে সেটাও একটি বিষয় ৷ আরেকটা বিকল্প হল, কোনও জায়গায় খাবার পৌঁছে দেওয়া মুশকিল হলে, সেখানে ক্যাশ ট্রান্সফার করা । অঙ্গনওয়াড়ির সুবিধাভোগীদের কাছে সহায়ক পুষ্টির বদলে প্রতি মাসে টাকা পৌঁছে দিয়েছে বিহার সরকার । আবার ক্যাশ ট্রান্সফার যদি হয়, তবে নিশ্চিত করতে হবে যাতে গ্রাহকদের সবার অ্যাকাউন্ট থাকে, তাঁদের কাছে টাকা সময়ে পৌঁছয় এবং যাতে তাঁরা সেটা কাজে লাগাতে পারেন ।
তৃতীয়ত, যেহেতু খাদ্যের অভাবে বাড়িতে রেশন ভাগাভাগি করা হয় এবং লকডাউনে খাদ্য সীমিত পরিমানে পাওয়া যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পুষ্টির ব্যাপারে মহিলাদের কাউন্সেলিং করাটাও গুরুত্বপূর্ণ । রেশন দেওয়ার সময়, অথবা স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন বাড়িতে গিয়ে সচেতনতা প্রসার করছেন, তখন এই কাউন্সেলিং করা যেতে পারে । গণমাধ্যম এবং রেডিওর মাধ্যমেও এই উদ্যোগকে সহায়তা করা যেতে পারে ।
পরিশেষে, গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা নিশ্চিত করতে, পুষ্টির জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ করতেই হবে । এর অর্থ, পুষ্টি বিষয়ক সমস্ত বরাদ্দ, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের পারিশ্রমিক সহ, ঠিক সময়ে এবং পুরোপুরি দিতে হবে ।
কেন্দ্রের ‘পোষণ অভিযান’ এবং এর আওতায় বিভিন্ন প্রচারের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে অপুষ্টি দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে । মহামারী এবং তারপর লকডাউন এই কর্মকাণ্ডের অনেকগুলোকেই থমকে দিয়েছে । অপুষ্টির বিরুদ্ধে ভারতের লাগাতার যুদ্ধে, এগুলোর ক্ষেত্রে ফের গতিবেগ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ ।
অবনী কাপুর, অধিকর্তা, অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইনিশিয়েটিভ
ঋত্বিক শুক্ল, সহকারী গবেষক, অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইনিশিয়েটিভ
অবন্তিকা শ্রীবাস্তব, সিনিয়র কমিউনিকেশনস অফিসার, অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইনিশিয়েটিভ