দিল্লি, 18 নভেম্বর : আইনের চোখে সবাই সমান ৷ শীর্ষ আদালতের সাংবিধান বেঞ্চ জানিয়ে দিল তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও তাঁর দপ্তর ৷ পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিতর্কেরও অবসান হল ৷
তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির থাকা নিয়ে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের এই রায় সার্বিকভাবেই প্রশংসনীয় । তথ্যের অধিকার ও ব্যক্তি পরিসরের স্বাধীনতা যে একই মুদ্রার দু'পিঠ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে সুরক্ষিত রাখতেই হবে, এই দুই বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিশ্লেষণ প্রশংসনীয় ।
প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বক্তব্য, "বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দায়িত্বকে হাত ধরাধরি করে চলতেই হবে । কিন্তু এটাও দেখতে হবে যেন বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা তার স্বাধীনতা লঙ্ঘন না করে ।" বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মতে,"বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, বিচারপতি ও আইনজীবীরা তার ঊর্ধ্বে ।" তিনি আরও বলেন, "একেবারে স্বতন্ত্র হয়ে বিচার বিভাগের কাজ করা সম্ভব নয় ৷ কারণ বিচারপতিরা সাংবিধানিক পদাধিকারী ৷ তাঁরা জনগণের স্বার্থে কাজ করছেন ।"
2016 সালে বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই মামলাটি সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে পাঠিয়েছিল । সেই থেকে ছ'বছর মামলাটি পড়েছিল । সাংবিধানিক বেঞ্চের সামনে যে প্রধান প্রশ্নগুলি ছিল তা হল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখতে গেলে কি তথ্য প্রকাশ করা যায় না? যে তথ্য চাওয়া হয়েছে তা কি বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপের সামিল? এ ছাড়াও দুই বিচারপতির বেঞ্চ সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে আরও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করে ।
রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চের পক্ষপাতহীন এই রায় তথ্যের অধিকার আইনকে আরও শক্তিশালী করেছে । দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে তথ্যের অধিকার আইন আমাদের আশার আলো দেখায় । রাজনৈতিক নেতারা যখন নিজেদের দুর্নীতি ঢাকতে শতাব্দী প্রাচীন আইনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছিল, তখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতই তথ্যের অধিকার আইনের মাধ্যমে আমাদের আশার আলো দেখিয়েছিল ।
বিতর্কের সূত্রপাত তথ্যের অধিকার আন্দোলনের কর্মী সুভাষ আগরওয়ালের একটি আবেদনকে কেন্দ্র করে । সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সহ সমস্ত বিচারপতিদের সম্পত্তির বিবরণ জানতে চেয়ে আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি । সুপ্রিম কোর্ট তখন তা জানাতে অস্বীকার করেছিল । সমস্যা জটিল হয় যখন জাতীয় তথ্য কমিশন তথ্যের অধিকার আইনে এই তথ্যগুলি জানতে চায় ।
স্বচ্ছতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করবে এই যুক্তিতে দিল্লি হাইকোর্টে জাতীয় তথ্য কমিশনের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করা হয় সুপ্রিম কোর্টের অফিসের তরফে । কিন্তু প্রথমে দিল্লি হাইকোর্টের এক সদস্যর বেঞ্চ এবং চারমাস পরে তিন সদস্যর বেঞ্চ বিষয়টিতে জাতীয় তথ্য কমিশনকেই সমর্থন করে । 2010 সালে দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সুপ্রিম কোর্টের সেক্রেটারি জেনেরাল । এমন এক আবেদন, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট নিজেই নিজের বিচারপ্রার্থী ৷ সেখানে বেঞ্চের রায় যায় তথ্যের স্বচ্ছতার দিকেই । এর আগে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় ন্যাশনাল জুডিসিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটি কমিশন অ্যাক্টের প্রস্তাব খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট । এ বিষয়ে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের বক্তব্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানে বিচার বিভাগকে শাসকের নজরদারি থেকে মুক্ত রাখা, সাধারণের থেকে নয় ৷ সুপ্রিম কোর্টকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে ।
ভারতীয় গণতন্ত্রে নাগরিকদের স্থান সবার উপরে । সংবিধানের 19 নম্বর অনুচ্ছেদ নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে সুরক্ষিত করার আশ্বাস দেয় । এই পরিসরেই আসে নাগরিকদের তথ্যের অধিকার । সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, যে কোনও প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে ভোটারদের সব তথ্য জানাতেই হবে । চলতি বছরের এপ্রিলে এক রায়ে শীর্ষ আদালত জানায়, সরকার জাতীয় সুরক্ষার দোহাই দিয়ে কোনও তথ্য গোপন করতে পারবে না । 2005 সালে তথ্যের অধিকার আইন বাস্তবের রূপ পাওয়ার পর থেকেই সরকার চেষ্টা করে এসেছে একে দুর্বল করতে । কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের দৃঢ়তায় সে সব চেষ্টা পর্যুদস্ত হয়েছে । সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এটা প্রমাণিত, আইনের চোখে সবাই এক । তথ্যের অধিকার আইন বিশ্বের সেরা পাঁচ আইনের একটির তকমা পেলেও সরকারের নীতি পঙ্গুত্বে তা ছ’নম্বরে নেমে গেছে । সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং তথ্যের অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের উপর যখন হুমকির পরিমাণ বেড়েই চলেছে, তখন শীর্ষ আদালতের এই রায় আশার আলো দেখালো । বহুদিন পর আজ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় আসতে বাধ্য হয়েছে ৷ দেশের নাগরিকদের কাছে স্বচ্ছ হতে বাধ্য হয়েছে । এই বিষয়গুলি দেশের গণতন্ত্রেরই জয়গান গায় ।