লেহ, 30 অক্টোবর:পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একফালি সবুজ ৷ তার মধ্যে দিয়ে বইছে সুরু নদী ৷ সিন্ধু নদীর শাখানদী ৷ এবড়ো খেবড়ো জমিতে নদী, সবুজ গাছের মাঝে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে ছোট ছোট বাড়িঘর, মসজিদ এবং বৌদ্ধ মন্দির ৷ ঠিক যেন ছবির মতো ! শস্য শ্যামলা ছোট্ট জনপদটির নাম সুরু উপত্যকা ৷ লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীরের সীমানায় কার্গিল জেলায় অবস্থিত ৷
সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বিশ্বের 25টি সবচেয়ে মনোরম পর্যটনের জায়গার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ৷ সেই তালিকায় দুনিয়ার অন্য জায়গার সঙ্গে নাম রয়েছে লাদাখের সুরু উপত্যকারও ৷ এই খবরে উচ্ছ্বসিত আঞ্চলিক পর্যটন আধিকারিকদের থেকে শুরু করে পর্যটন সংস্থাগুলি এবং গ্রামবাসীরা ৷
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে পশ্চিম লাদাখ থেকে পশমিনা উল যেত কাশ্মীরে ৷ সেই উল দিয়ে তৈরি হত উন্নত মানের সুন্দর শাল ৷ সেই সব শাল এবং অন্য সামগ্রী তিব্বত হয়ে লাদাখ, তারপর কাশ্মীর দিয়ে পৌঁছে যেত মধ্য এশিয়ায় ৷
এই যাত্রাপথের মধ্যে পড়ত সুরু উপত্যকা-সহ আরও বেশ কয়েকটি উপত্যকা ৷ তাদের সবগুলিকে একসঙ্গে পুরিগ বলা হত ৷ এই পুরিগের ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর বাস ছিল ৷ তাদের প্রধানরা 'চো' নামে পরিচিত ছিলেন ৷ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে লাদাখে বৌদ্ধ ধর্ম এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতির প্রভাব তুঙ্গে ৷
এমন সময়ে লাদাখের এই অঞ্চল দখল করেন মুসলিম শাসকরা ৷ তাঁদের সঙ্গে আসেন ধর্মপ্রচারকরাও ৷ তেমনই একজন মীর হাশিম ৷ সুরু কার্টসের ইতিহাসে তিনি একবিংশ শতকেও স্মরণীয় ৷ ঐতিহাসিকদের মতে, তিনিই প্রথম এখানে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন ৷ সুরুতে রয়েছে তাঁর সমাধিক্ষেত্র ৷
ধর্মাবলম্বীদের অনেকে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে এসে ধর্ম পরিবর্তন করেন ৷ তাই লাদাখের এই সুরু উপত্যকায় বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে বাস করছে ইসলাম ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার ৷ প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের সঙ্গে দেখা মিলবে বহু পুরনো মসজিদেরও ৷ সুরু উপত্যকার নিজস্ব তেমন ইতিহাস না থাকলেও, এই উপত্যকা বহু ইতিহাসের সাক্ষী ৷ বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্ম-সংস্কৃতির নিদর্শনগুলি সেই ইতিহাসেরই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ৷
সানকু সুরু ভ্যালি (ছবি সৌজন্য: ফিরোজ হুসেন লাটি) প্রাচীন ধর্ম, সংস্কৃতির সঙ্গে সুরুর প্রাকৃতিক আকর্ষণও কম নয় ৷ পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ট্রেকিং রুটের জন্য একসময় জনপ্রিয় ছিল সুরু উপত্যকা ৷ লাদাখ রুটস নামের একটি পর্যটন সংস্থার সিইও মুজাম্মিল হুসেন বলেন, "এটা একটা দারুণ খবর ৷ বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা কার্গিল ও সুরুকে জনপ্রিয় পর্যটন স্থল হিসেবে প্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছি ৷ সুরু দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারের জায়গা ৷ গত শতাব্দীর সাত ও আটের দশকে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের কাছে সুরু খুব জনপ্রিয় ছিল ৷ এরপর নয়ের দশকে কাশ্মীরে নানারকম গণ্ডগোলের ফলে মানুষের যাতায়াত কমতে থাকে ৷ বিশেষত কার্গিল যুদ্ধের সময় থেকে ৷"
সুরুর ম্যাপ হাতে নিয়ে হুসেন বলতে থাকেন, "আমরা সেই সময় জম্মু-কাশ্মীরের অংশ ছিলাম ৷ পানিকখর থেকে পহেলগামে অনেকগুলি ট্রেকিং রুট ছিল, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হল ৷ লাইন অফ কন্ট্রোল (এলওসি) থেকে এর দূরত্বের জন্য বহু পর্যটক, বিশেষ করে বিদেশিরা এখানে আসতেন ৷ কিন্তু পরে এই সংখ্যাও কমে যায় ৷ সুরু ভ্যালি আবারও মানচিত্রে ফিরে এসেছে ৷ দারুণ খবর !"
ন্যাশনাল জিওগ্রাফির 25টি পর্যটনস্থলের তালিকায় স্থান পেয়েছে সুরু ৷ এই খবরে উচ্ছ্বসিত কার্গিলের এক হোটেল ব্যবসায়ী নাসির হুসেন মুন্সি ৷ তিনি জানালেন, সুরু নদীর তীরের পাহাড়গুলিতে দুর্ধর্ষ সব পাহাড়ি পথ রয়েছে ৷ আছে পাহাড়ের গায়ে সবুজ জঙ্গল এবং এখানকার প্রাণবন্ত রঙিন সম্প্রদায়গুলি ৷ তাঁর কথায়, "সুরু উপত্যকা প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক- দু'দিক দিয়েই সমৃদ্ধ ৷ এখানে মীর হাশিমের সমাধি রয়েছে ৷ যিনি পুরিগ রাজত্বে ইসলাম ধর্মের প্রচার করেছিলেন ৷ গৌতম বুদ্ধের মূর্তি থেকে শুরু করে অভালোকিস্তওয়ারার মূর্তি আছে ৷ প্রাচীন পুরিগ রাজত্বের সময়ে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল কার্টসে খার ৷ শীতকালে খারপো খার ৷"
তিনি আরও বলেন, "যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, তাঁদের জন্য এখানে নান ও কুন পর্বত রয়েছে ৷ জমিয়ে প্যারাগ্লাইডিং, ব়্যাফটিং করতে পারবেন ৷ তাই অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী মানুষরা এখানে আনন্দের সুযোগ পাবেন ৷ এর আগেও আমরা এই জায়গাটা নিয়ে প্রচার করেছি ৷ কিন্তু এটা জাসকরে যাওয়ার একটা রুট হিসেবে পরিচিত পেল পর্যটকদের কাছে ৷" তাছাড়া এমন একটা ছবির মতো সুন্দর জায়গায় সিনেমার শুটিংও তো হতে পারে, মনে করালেন মুন্সি ৷ তিনি বলেন, "এত সুন্দর ল্য়ান্ডস্কেপ, ঐতিহ্যবাহী একটা জায়গা সিনেমার শুটিংয়ের জন্য আদর্শ ৷"
কী বলছেন ঐতিহাসিক ড. স্ট্যানজিন মিনগ্যুর ? তিনি সুরু ভ্যালির ঐতিহ্য তুলে ধরে বলেন, "এখানে একের পর এক এমন মূর্তি আছে, যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম ৷ মূর্তিগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মৈত্রেয়া বুদ্ধ মূর্তি ৷ কার্টসে গ্রামে আছে ৷ অষ্টম কি নবম শতকে তৈরি ৷ কাশ্মীরের নিজস্ব শিল্পকলা এই বুদ্ধ মূর্তিতে স্পষ্ট ৷ গবেষক ও পণ্ডিতদের মতে, এই মূর্তি কাশ্মীরের একেবারে নিজের শিল্পকলায় গড়া হয়েছিল ৷ ভোতি ভাষায় একটা দীর্ঘ শিলালেখ খোদাই করা হয়েছে, যার কিছুটা পড়া সম্ভব হয়েছে ৷"
এই ধরনের মূর্তিগুলি দেখে বোঝা যায় যে, কাশ্মীরি শিল্পীরা নিজে হাতে বৌদ্ধ মূর্তিগুলি তৈরি করেছিলেন ৷ ড. স্ট্যানজিন আরও বলেন, "কার্টসে বুদ্ধ মূর্তিতে বামিয়ান বুদ্ধের প্রভাব দেখা যায় ৷ আরেকটি উল্লেখযোগ্য বুদ্ধ মূর্তি বেমা খুমবু ৷ এই মুর্তিতেও ভোতি ভাষায় শিলালেখ খোদাই করা আছে ৷ এতে প্রমাণিত যে, সেই সময় কাশ্মীরের শিল্পীরা লাদাখে গিয়ে এইরকম স্মরণীয় মূর্তিগুলি নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন ৷ এই শিল্পকলা লাদাখকে তার সীমা ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর নিয়ে গিয়েছে ৷"
সুর ভ্যালি থেকে পাওয়া বুদ্ধ মূর্তিগুলি একেবারে স্বতন্ত্র ৷ অন্য জায়গা থেকে যে বুদ্ধ মূর্তি উদ্ধার হয়েছে, তার থেকে আলাদা ৷ এই মূর্তিগুলি ক্ষয়ে যাচ্ছিল ৷ পরে সেগুলিকে সংরক্ষণ করা হয় বলে জানান ঐতিহাসিক ৷
কার্টসে খারে দুর্গের ভগ্নাবশেষ (ছবি সৌজন্য: ফিরোজ হুসেন লাটি) সুরু ভ্যালিতে বেড়াতে এলে সুন্দর থাকার জায়গার অভাব হবে না ৷ খারপোকারের একটি রিসর্টের কর্ণধার গুলাম মহম্মদ বলেন, "আমাদের রিসর্টটা কাউন্সিলরের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে ৷ অতীতে আশপাশের এলাকা থেকে এবং দূরদূরান্তের পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসতেন ৷ সুরু ভ্যালি আবার পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, এটাই তো হওয়া উচিত ৷ এতে কার্গিলের চারদিকে পর্যটনে উন্নতি হবে ৷"
ভারতের ভূ-স্বর্গ বলা হয় জম্মু-কাশ্মীরকে ৷ সাধারণ মানুষের কাছে এর আকর্ষণ বরাবরই ৷ কিন্তু সন্ত্রাসবাদী হামলার ফলে এলাকার পর্যটন স্থলগুলি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল ৷ উপত্যকা আতঙ্কের আরেক নাম হয়ে উঠেছিল পর্যটকদের কাছে ৷ সময় বদলেছে ৷ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর মতো জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক সংস্থার তালিকাভুক্ত হয়েছে সুরু ভ্যালি ৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ঐতিহ্যবাহী এই এলাকায় ফিরবে পর্যটন ? উত্তর দেবে সময় ৷