লোকপুর (বীরভূম), 11 ডিসেম্বর: ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা প্রাচীন 'সের-পাই' কুটির শিল্প কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে ৷ এই শিল্পের আরেক নাম 'সিউড়ি-বোল'। বীরভূমের লোকপুরে একমাত্র কর্মকার পরিবার এই শিল্পকে কোনও রকমে বাঁচিয়ে রেখেছে ৷
একদা ওজনের একক সের, পাই, ছটাক আজ এক অনন্য শিল্পকর্ম ৷ আম কাঠ ও পিতল দিয়ে তৈরি এই শিল্পের প্রসার ও চাহিদা রয়েছে যথেষ্ট । রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিল্পী ভোলানাথ কর্মকার ও তাঁর স্ত্রী রুমা কর্মকারের আক্ষেপ, যদি প্রশাসন হস্তক্ষেপ না-করে তাহলে অচিরেই হারিয়ে যাবে এই শিল্প ৷ যদিও সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই মেলে না বলে অভিযোগ ৷
ব্রিটিশ আমলের 'সের-পাই' শিল্প (নিজস্ব ভিডিয়ো) শিল্পী ভোলানাথ কর্মকার বলেন, "আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছ থেকে এই শিক্ষা পাওয়া ৷ 100 বছরের প্রাচীন এই শিল্প । আমি 'সের-পাই' নিয়ে বহু জায়গায় গিয়েছি ৷ আগে ওজন হত, এখন তা শিল্প । তবে আমার একটাই চিন্তা, কী করে বেঁচে থাকবে এই শিল্প ৷ প্রশাসনের আধিকারিকেরা আসেন, প্রতিশ্রুতি দেন, চলে যান ৷ সরকার যদি সহযোগিতা না-করে, তাহলে এই শিল্প হারিয়ে যাবে ৷ আমরা একটাই পরিবার এখন এই কাজ করি । এই শিল্পের জন্য আমি ও স্ত্রী রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারও পেয়েছি ।"
'সের-পাই' শিল্পের একমাত্র ধারক ও বাহক (নিজস্ব চিত্র) এক সময় গ্রামে-গঞ্জে-পল্লিতে ধান, গম, চাল, দুধ প্রভৃতি পরিমাপের একক ছিল সের, পাই, আধ পাই, পোয়া, আধ পোয়া, ছটাক প্রভৃতি । এক পাই-এর অর্থ প্রায় 466 গ্রাম ৷ দুই পাইয়ে হয় এক সের ৷ অর্থাৎ এক সের মানে হল প্রায় 933 গ্রাম ৷ তবে একদা এই পরিমাপের একক আজ এক অনন্য শিল্পকর্ম । আম কাঠের সের ও পাই-এর উপর পিতল দিয়ে নিঁখুত সব শিল্পকর্ম চোখে পড়ার মতো । বড় থেকে ছোট পরিমাপের একক সাজিয়ে সাজিয়ে তৈরি হয় অভূতপূর্ব শিল্প ।
বীরভূমের পরিবারের হাত ধরে বেঁচে আছে এই শিল্প (নিজস্ব চিত্র) বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের লোকপুর থানার কর্মকার পাড়ায় ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে এই শিল্প । শিল্পী কার্তিক কর্মকারের হাত ধরে এই শিল্পের প্রসার ঘটেছিল ৷ এই শিল্পের বিকাশের জন্য 1965 সালে তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন ৷ তাঁর পরবর্তীতে এই শিল্পের ধারক ও বাহক ভোলানাথ কর্মকার । তিনি কার্তিক কর্মকারের ছাত্র তথা জামাই । বর্তমানে এই ভোলানাথ কর্মকার ও তাঁর স্ত্রী রুমা কর্মকার এই কুটির শিল্পকে কোনও রকমে টিকিয়ে রেখেছেন ৷
এর আরেক নাম 'সিউড়ি-বোল' (নিজস্ব চিত্র) শিল্প বিকাশের ও শিল্পসত্ত্বার জন্য 2014 সালে ভোলানাথ কর্মকারও রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান ৷ এমনকি, 2017 সালে তাঁর স্ত্রী রুমা কর্মকারও রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান ৷ এছাড়া, তাঁদের তিন মেয়ে মনীষা, প্রিয়া ও রিয়া কর্মকারও বাবা-মায়ের সঙ্গে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ৷ এক কথায় এই একটি মাত্র পরিবার এই শিল্পকে আঁকড়ে বাঁচেন ও শিল্পটিকেও বাঁচান ৷ জানা গিয়েছে, ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে বীরভূমের সদর শহর সিউড়িতে বড়লাট এসেছিলেন ৷ তাঁকে 'সের-পাই' শিল্পকর্মটি উপহার দেওয়া হয়েছিল । উপহার পেয়ে আপ্লুত হয়ে বড়লাট এই শিল্পের নাম দিয়েছিলেন 'সিউড়ি-বোল'।
শিল্পী ভোলানাথ কর্মকার (নিজস্ব চিত্র) এই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও প্রত্যন্ত কর্মকার পাড়া থেকে 'সের-পাই' শিল্প পাড়ি দিয়েছে মুম্বই, ভোপাল, দিল্লি, বেঙ্গালুরু প্রভৃতি জায়গায় ৷ 2 হাজার থেকে 10 হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্য নির্ধারণ করেন শিল্পী ৷ একই পরিবারের তিনজন রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিল্পী । তবে সরকারি অবহেলায় কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে বীরভূমের এই প্রাচীন কুটির শিল্পটি ৷
শিল্পী ভোলানাথ কর্মকারের স্ত্রী (নিজস্ব চিত্র) রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিল্পী রুমা কর্মকার বলেন, "আমরা একটাই পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত । অনেকেই আসে, শেখে, চলে যায় ৷ সরকারি কোনও হেলদোল নেই ৷ তাই 'সের-পাই' শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না ।"
ভোলানাথ ও রুমা কর্মকারের মেয়ে প্রিয়া কর্মকার বলেন, "আমরা তিন বোন বাবা-মায়ের কাছ থেকে সের-পাই বা সিউড়ি বোল বানানো শিখছি ৷ তবে এই শিল্প বাঁচাতে অনেক প্রশিক্ষণ চাই ৷ সরকার যদি প্রশিক্ষণের জন্য সহযোগিতা না-করে তাহলে হারিয়ে যাবে শিল্পটি ৷ মানুষজনের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে ।"