বেলডাঙা, 15 সেপ্টেম্বর: 'ঢপ' কীর্তনের প্রবর্তক তথা ‘জনক’ রূপচাঁদ অধিকারীর বেলডাঙার বাস্তুভিটে সংস্কার ও সংরক্ষণের জোরালো দাবি উঠল । বেলডাঙার দক্ষিণপাড়ায় জমিদার জগৎ শেঠের তৈরি করে দেওয়া দালান সংস্কারের অভাবে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে ।
স্থানীয় মানুষের দাবি, এই দালান বাড়িটি বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আসছে । সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবিতে স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসনের কাছে একাধিকবার দরবার করা হয়েছিল বলে দাবি রূপচাঁদ অনুরাগীদের । সম্প্রতি বেলডাঙা ‘অহল্যা লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’-এর পক্ষ থেকে আরও জোরালো দাবি তোলা হয়েছে । অনুরাগীদের অভিযোগ, রূপচাঁদ অধিকারীকে মুলধন করে বহু ইতিহাসবিদ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক স্বীকৃতি পেয়েছেন । অথচ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ্বে তৈরি দালানটি এখন ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি গবেষকদের দেওয়া তথ্য থেকে জানতে পারা গিয়েছে, আনুমানিক 1722 সালে বেলডাঙায় বাবার মামার বাড়িতে জন্ম রূপচাঁদ অধিকারীর । আদি বাড়ি কান্দি মহকুমার সালার থানার তালিবপুরে । বাবা প্রাণকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়কে সন্তানহীন মামা বেলডাঙায় নিজের বাড়িতে এনে রাখেন । প্রাণকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় মামার বাড়িতে দেবসেবা ও শিষ্যদের দীক্ষাদানের কারণে ‘অধিকারী’ উপাধি পান । জন্ম থেকেই সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল রুপচাঁদ অধিকারীর । পরে গৃহত্যাগ করে মুর্শিদাবাদের সালারের অনতিদূরে শিমুলিয়া গ্রামে এক সন্ন্যাসীর কাছে প্রথামতো প্রচলিত সঙ্গীত শিক্ষাগ্রহণ করেন । সেই সাধু তাঁর সঙ্গীত অনুরাগে মুগ্ধ হয়ে একটি ‘ডুবকী’ (ডুমরু জাতীয় বাদ্যযন্ত্র) উপহার দেন । ঢপ কীর্তনে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে ওই ডুবকী ব্যবহার করতেন তিনি ।
আগাছায় ঢেকেছে ঢপ কীর্তনের প্রবর্তকের ভিটে (নিজস্ব চিত্র) কীর্তন বিশেষজ্ঞদের অনুমান, মুর্শিদাবাদের অন্যতম ঘরানা (মনোহরশাহী ঘরানা)কে ভেঙে হালকা সুরের সৃষ্টি করেন রূপচাঁদ অধিকারী । রূপচাঁদের সৃষ্ট এই কীর্তন গানই ঢপ কীর্তন নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে । প্রচলিত কীর্তন গানের থেকে ঢপ কীর্তন ছিল অনেক সহজ, সরল ও লৌকিক ধারার । এমনকি সে সময় হিন্দু শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানেও ঢপ কীর্তন গাওয়া হত বলে অনেকের দাবি । সধারণ পালা কীর্তনের মতো রূপচাঁদ ঢপ কীর্তনে দান, মাথুর, মান, নৌকা বিলাস পালার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন । রূপচাঁদের পথ ধরে পরে অঘোর দাস, দ্বারিক দাস, মধূসুদন কান, মোহন দাসের মতো শিল্পীরা খ্যাতি পেয়েছিলেন । লোকশিল্পী গবেষক শক্তিনাথ ঝাঁ বলেন, ঢপ প্রচলিত কীর্তন গানের সরলীকরণ রূপ । কীর্তন গানের রসিকরা এই রীতিকে পছন্দ করতেন না । কিন্তু জনসমাজে এই ধারার জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক ।
রূপচাঁদ অধিকারীর গানে মুদ্ধ হয়ে বেলডঙার জমিদার জগৎ শেঠ তাঁকে করমুক্ত বেশকিছু কৃষিজমি ও দালান বাড়িটি তৈরি করে দেন । 1802 সালে এই দালান বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রূপচাঁদ অধিকারী । দালাল বাড়ির শিল্প শৈলী অনেক আগেই খসে খসে পড়েছে । এখন চারিদিক লতাপাতা এমন বিস্তার করেছে যে পা বাড়ানো যায় না । সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে সন্ন্যাসীর দেওয়া ডুবকী-সহ রূপচাঁদের অনবদ্য পদগুলি এই ধ্বংসাবশেষের নীচেই চাপা পড়ে রয়েছে ।
বেলডাঙা অহল্যা লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত লেখক রাজকুমার শেখ বলেন, "বহু স্থান সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হলেও আজও অবহেলিত রূপচাঁদ অধিকারীর বাস্তুভিটে । আমরা আগে অনেক চেষ্টা করেছি । কিন্তু প্রশাসনের নজর ঘোরাতে পারিনি । সম্প্রতি অহল্যা লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র সংস্কারের দাবিতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে ।"
সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র্রর প্রধান সম্পাদক সন্তোষরঞ্জন দাস বলেন, "ঢপ কীর্তন নামক লোকসংস্কৃতির জনককে আমরা তাঁর যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি । অহল্যার পক্ষ থেকে বসত ভিটে সংস্কার, সংরক্ষণ করে হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের মর্যাদা দেওয়ার আওয়াজ তুলেছি ।" পাশাপাশি রূপচাঁদ অধিকারীর যেহেতু কোনও ছবি পাওয়া যায়নি, তাই তাঁর সৃষ্টির দু‘কলি দিয়ে একটি স্মৃতি ফলকের দাবি তুলেছেন অহল্যা লোকসংস্কৃতির সদস্যরা ।