পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / opinion

অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে ইজরায়েল-হামাস, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরবে কি - ISRAEL HAMAS CEASEFIRE DEAL

গত রবিবার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে ৷ তবে প্রশ্ন থাকছে মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি ফেরা নিয়ে ৷

Israel Hamas Ceasefire Deal
মুক্তিপ্রাপ্ত প্যালেস্তানীয় বন্দিদের বহনকারী একটি বাস ওয়েস্ট ব্যাংকের বেইতুনিয়া শহরে পৌঁছয়। সোমবার৷ (এপি)

By Major General Harsha Kakar

Published : Jan 21, 2025, 7:24 PM IST

ইজরায়েল ও হামাস একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে, যা রবিবার থেকে শুরু হয়েছে । কয়েক মাস ধরে অনেক আলোচনার পর এই চুক্তি কার্যকর হয়েছে ৷ এমন সময় এই চুক্তি কার্যকর হল, ঠিক যখন বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর মেয়াদ শেষ করছেন । বাইডেন ও ট্রাম্প উভয়েই যুদ্ধবিরতি করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব নিয়েছেন ৷ ট্রাম্প দাবি করেছেন, ‘‘এই মহাকাব্যিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি কেবল নভেম্বরে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলেই সম্ভব হয়েছে । হোয়াইট হাউসে না থাকা সত্ত্বেও আমরা এত কিছু অর্জন করেছি ।’’ বাইডেন উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমরা সকলেই একই কণ্ঠে কথা বলছি ৷ কারণ, আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা এটাই করেন ।’’

গাজায় যারা রয়েছে, তারা লড়াই শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উদযাপন করেছে ৷ তাদের সিনিয়র নেতা এবং প্রধান সমঝোতাকারী খলিল আল-হাইয়া উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমাদের জনগণ দখলদারিত্বের ঘোষিত এবং গোপন লক্ষ্যগুলিকে আটকাতে পেরেছে ৷ আজ আমরা প্রমাণ করছি যে দখলদারিত্ব কখনও আমাদের জনগণ এবং তাঁদের প্রতিরোধকে পরাজিত করতে পারবে না ।’’ এদিকে, একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে হামাস নতুন জঙ্গি নিয়োগ করেছে নিজেদের দলে ৷ এর ফলে ইজরায়েলের আক্রমণের আগে তাদের যা শক্তি ছিল, তা পুনরায় তারা তৈরি করেছে ৷ এর ফলে বোঝা যাচ্ছে এই ধ্বংসযজ্ঞ এবং ক্ষতি সত্ত্বেও হামাসের আদর্শ ও জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রয়েছে ।

গাজায় হামাস জঙ্গিদের হাতে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দক্ষিণ ইসরায়েলের কিবুৎজ রেইমের কাছে রোমি গোনেন (ডানদিকে) এবং তার মা মেরাভকে জড়িয়ে ধরেছেন৷ রবিবার৷ (ইজরায়েল সেনা ভায়া এপি)

গাজার বাসিন্দারা তাঁদের ঘরবাড়ি ও হাসপাতাল ধ্বংসের জন্য চিৎকার করেছিলেন ৷ তাঁরা দাবি করেছিলেন, 40 হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে ৷ ইজরায়েলি আক্রমণকে তাঁরা গণহত্যা বলে অভিহিত করেছিলেন ৷ ক্ষুধার্ত ও মৃত শিশুদের ছবি প্রদর্শন করেছিলেন ৷ গাজার সেই একই বাসিন্দারা এখন যুদ্ধবিরতিকে বিজয় হিসেবে বিবেচনা করছেন । এটা কি পরিহাস ! নাকি মগজ ধোলাইয়ের জেরে এটা ঘটছে ।

হামাস তার জনগণের জন্য অকল্পনীয় দুর্ভোগ সৃষ্টি করার পরেও গাজায় জনপ্রিয় । তারা গাজাবাসীদের খাদ্য ও ওষুধের জন্য সংগ্রামরত একটি সম্প্রদায়ে পরিণত করেছে ৷ কোনও কৌশলগত হিসাব ছাড়াই শুরু হওয়া যুদ্ধে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে গাজার বাসিন্দাদের । ইজরায়েলি হামলায় তারা প্রায় পুরো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে ৷ তবে, জঙ্গি সংগঠনগুলির মধ্যে নেতাদের অভাব নেই ৷ তাই যাদের নির্মূল করা হয়েছে, তাদের বদলে অন্য কেউ দায়িত্ব নিয়েছে সহজেই ৷

যখন সাধারণ ইজরায়েলিরা চুক্তিটি উদযাপন করছিলেন, পরিবারের সদস্যরা বন্দি প্রিয়জনদের ফিরে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, তখন সরকারের ভেতরে অস্থিরতা বিরাজ করছিল । এমনকি সৈন্যদের পরিবারও যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ বাড়িয়েছিল । ইজরায়েল এখন পর্যন্ত যুদ্ধে 400 জনেরও বেশি সৈন্য হারিয়েছে ৷ আরও অনেক আহত হয়েছেন ।

গাজায় হামাস জঙ্গিদের বন্দিদশা থেকে পাওয়ার পর দক্ষিণ ইজরায়েলের কিবুতজ রেইমের কাছে এমিলি দামারি (ডানদিকে) এবং তার মা ম্যান্ডি আলিঙ্গন করছেন। রবিবার৷ (ইজরায়েল সেনা ভায়া এপি)

ইজরায়েলের অতি-ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির এবং ধর্মীয় ইহুদি শক্তি দলের আরও দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন । এর ফলে বর্তমান জোট ভাঙবে না, বা যুদ্ধবিরতির উপর প্রভাব পড়বে না ৷ বরং জোটকে অস্থিতিশীল করে তুলবে ।

এমন খবর রয়েছে যে নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক লাভের জন্য লড়াই বন্ধের চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন ৷ কারণ, এর ফলে তাঁর জোট সমাপ্তি দিকে যেতে পারে ৷ এমনও জানা যাচ্ছে যে নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে 33 জন বন্দিকে ফিরিয়ে আনার পর ফের যুদ্ধ শুরু করতে পারেন ৷

যুদ্ধবিরতি আরও ইঙ্গিত দেয় যে ইজরায়েল হামাসের আদর্শকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়নি । এই যুদ্ধ হামাসের সামরিক কাঠামো ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে ৷ তবে এই গোষ্ঠী এখন নিজেকে একটি বিদ্রোহী বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছে ৷ তারা এখনও ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করছে । গত সপ্তাহে বিদ্রোহীদের হামলায় ইজরায়েলের 16 জন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে । এর অর্থ হল গাজা থেকে হামাসকে সরিয়ে দেওয়া সহজ কাজ হবে না । তারা বিদ্যমান এবং একটি কার্যকর শক্তি হিসেবে রয়ে যাবে ।

গাজায় হামাস জঙ্গিদের দ্বারা দক্ষিণ ইজরায়েলের কিবুৎজ রেইমের কাছে ডোরন স্টেইনব্রেচার (বাঁদিকে) ও তাঁর মা সিমোনা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছেন। রবিবার৷ (ইজরায়েল সেনা ভায়া এপি)

ইরান গাজার জনগণের প্রতিরোধকে সমর্থন করেছে । আয়াতুল্লাহ খামেনি টুইট করেছেন, ‘‘সবাই বুঝতে পারবে যে জনগণের ধৈর্য এবং প্যালেস্তানীয়দের প্রতিরোধের দৃঢ়তাই ইহুদিবাদী সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল ।’’ ইরান এখন প্রায় একা । সিরিয়ার সমর্থন শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ হিজবুল্লা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং ইতিমধ্যেই ইজরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ৷ হুথিদের উপর তীব্র আঘাত হানছে এবং হামাসকে সহজে পুনরায় সাহায্য করা যাচ্ছে না । ইজরায়েলি বিমান হামলার ফলে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়েছে ৷ এর ফলে এটি ইজরায়েলি এবং মার্কিন বিমান হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে । তারা জানে যে ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হল শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ।

ভবিষ্যতের আলোচনায় যেসব মতবিরোধ প্রাধান্য পেতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে গাজার শাসন এবং পুনর্গঠনের বিষয়টিও ৷ যদিও ইজরায়েলের পছন্দের তালিকায় মিশর ও কাতারের পাশাপাশি রাষ্ট্রসংঘও রয়েছে ৷ কারণ, প্যালেস্তাইনের কর্তৃপক্ষ গাজায় শাসনের দাবি তুলে ধরছে । তেল আভিভ প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করে না এবং তাদের কোনও ভূমিকা দিতে অনিচ্ছুক । মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরপরই আফগানিস্তানে তালিবানদের মতো গাজায় হামাসের পুনরায় উত্থান ঠেকাতে ইজরায়েলকে সমস্ত কৌশল ব্যবহার করতে হবে । এটা হয়তো সহজ হবে না ।

এই চুক্তি আইএমইসি (ভারত মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিক করিডোর) শুরুর পথ প্রশস্ত করে । মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কারণে এটি স্থগিত হয়ে পড়েছিল । এই করিডোরটি চিনা বিআরআই (বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ) এর বিকল্প । এতদিন এটি কেবল কাগজে কলমেই রয়ে গিয়েছিল । আইএমইসি সম্পর্কে বাইডেনের ঘোষণা ইঙ্গিত দেয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রকল্পের প্রতি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে ।

ইজরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর হুইলচেয়ারে থাকা প্যালেস্তাইনের একজন মহিলা বন্দিকে স্বাগত জানানো হচ্ছে ওয়েস্ট ব্যাংকের বেইতুনিয়া শহরে। সোমবার৷ (এপি)

সন্দেহ নেই যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির যে শর্তগুলি রয়েছে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সমঝোতাকারীরা অগ্রাহ্য করে ৷ একদিকে কাতার ও মিশর হামাসের উপর চাপ প্রয়োগ করে, অন্যদিকে আমেরিকা নেতানিয়াহুকে চুক্তি মেনে নিতে রাজি করায় ৷ ইজরায়েলে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ সত্ত্বেও, এটা স্পষ্ট ছিল যে চুক্তি গৃহীত হবে । এটা বাইডেনের জন্য মুখরক্ষাকারী এবং ট্রাম্পের জন্য একটি জয় ছিল । মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে ও ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর এই চুক্তি কি টিকবে, সেটাই এখন প্রশ্ন ৷

ইজরায়েলের কাছে হামাসের পুনরুত্থান গ্রহণযোগ্য নয় ৷ কিন্তু এটাই বাস্তব৷ গাজার জনগণের মধ্যে হামাসের আদর্শ ও সমর্থন আগের মতোই শক্তিশালী রয়েছে । গাজার রাজনীতি থেকে হামাসকে দূরে রাখা কঠিন । একটি বিষয় নিশ্চিত, 33 জন বন্দির এই দলটি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত ইজরায়েল শান্তি বজায় রাখবে । ততক্ষণ পর্যন্ত চুক্তি থেকে সরে আসার সামর্থ্য তাদের নেই ।

ইজরায়েলও আর আগের মতো নেই । হামাসের সুড়ঙ্গগুলি মূলত ধ্বংস করা হয়েছে ও আগের মতো ইরান থেকে অস্ত্র পাবে না তারা ৷ হামাসের কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখা হবে । 7 অক্টোবরের মতো একই ধরনের হামলার আশঙ্কা ইজরায়েলি মানসিকতাকে প্রভাবিত করবে এবং তাই সামান্যতম অজুহাতে বিমান হামলা আশা করা যেতে পারে । প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলিদের মধ্যে আস্থার ভাটা পড়েছে । দীর্ঘ সময়ের জন্য আস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে নাও আসতে পারে ।

বেশিরভাগ শক্তিশালী আরব রাষ্ট্রই হয় নিরপেক্ষ ছিল অথবা পুরো সংঘাত জুড়ে ইজরায়েলকে নীরবে সমর্থন করেছিল । তারা ইজরায়েলের সমালোচনা করেছিল ৷ হুমকি দিয়েছিল ৷ কিন্তু তা কার্যকর করেনি ৷ প্রতিবেশী মিশর-সহ কেউই প্যালেস্তাইনের শরণার্থীদের গ্রহণ করতে রাজি ছিল না । গাজার জনগণের বিশ্বব্যাপী সমর্থন খুব কম ছিল । যা কিছু এসেছিল, তা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো গুরুত্বহীন বা আফ্রিকার ইসলামী দেশগুলি থেকে । এটা ইঙ্গিত দেয় যে এই অঞ্চলের দেশগুলি সংঘর্ষের চেয়ে ইজরায়েলের সাথে শান্তি ও সহযোগিতা পছন্দ করে । যদিও তারা গাজার পুনর্গঠনে অবদান রাখবে ৷ কিন্তু তারা কখনোই হামাসের পুনরুত্থান চাইবে না । একটি সংগঠন হিসেবে হামাস আর গ্রহণযোগ্য বা সম্মানিত নয়। এটাই পশ্চিম এশিয়ার পরিবর্তিত চেহারা ।

সবশেষে বলা যায় যে যুদ্ধবিরতি কিন্তু হয়েছে৷ কারণ, শত্রুতা বন্ধ হয়নি । যেকোনও পক্ষই ইচ্ছামতো তা ভাঙতে পারে ।

(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)

ABOUT THE AUTHOR

...view details