রাম কৌন্দিন্য
কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষকদের অর্থ উপার্জন নিশ্চিত করতে হবে । কৃষকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা নানা কারণে অনেক কৃষিকাজে লাভ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে । প্রস্তাবিত প্রতিকারগুলির মধ্যে অন্যতম হল কৃষকদের মূল্য শৃঙ্খলে নিয়ে আসা, যা কৃষকদের আরও লাভজনক হওয়ার সুযোগ করে দেবে ।
বর্তমানে, ভারত প্রায় 50 বিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষিপণ্য রফতানি করে, কিন্তু ভ্যালু-অ্যাডেড প্রডাক্ট বা মূল্য সংযোজন পণ্য এর মাত্র 15 শতাংশ । বাকি 85 শতাংশ আসে কাঁচা কৃষিপণ্য রফতানি করে, যার ফলে আমাদের রফতানির মূল্য চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ইতালি এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় কম, এদের রফতানি মূল্য সংযোজন পণ্যের চল্লিশ শতাংশেরও বেশি ।
মূল্যের দিক থেকে তারা বিশ্বব্যাপী কৃষি বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করে । ভারত 100 বিলিয়ন ডলারে রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে । মূল্য সংযোজন পণ্যের মাধ্যমে আমাদের কমপক্ষে 30 শতাংশ অবদান রেখে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে । এটি কৃষকদের লাভ বৃদ্ধি করবে । বিশ্বের পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের সঙ্গে সঙ্গে ভারত পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে পারে এবং অনেক দেশের পছন্দের সরবরাহকারী হয়ে উঠতে পারে ।
মূল্য শৃঙ্খল কী ?
এটি কৃষিপণ্যের একটি শৃঙ্খল, যেখানে খামার থেকে উপভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি সংযোগে উৎপাদনের মূল্য যুক্ত করা হয় । এই শৃঙ্খলটি ছোট হওয়া উচিত এবং শৃঙ্খলের প্রতিটি সংযোগকে তার খরচের থেকে বেশি মূল্য সংযোজন করতে হবে ।
দুটি তেলুগু রাজ্য (অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলঙ্গানা) দেশীয় এবং রফতানি বাজার উভয়ের জন্য মূল্য শৃঙ্খল তৈরি করে উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হতে পারে । আইটিসি এই রাজ্যগুলিতে লঙ্কার মূল্য শৃঙ্খল তৈরি করেছে এবং এটি রফতানির জন্য ব্যবহার করেছে । কিন্তু অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি কিছু এখনও করা হয়নি । অন্যান্য রাজ্য এবং দেশের তুলনায় কোন কৃষিপণ্যে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা রয়েছে তা নির্ধারণ করতে হবে প্রতিটি রাজ্যকে এবং সেই মতো সেই দিকে তাদের মনোনিবেশ করতে হবে । এই ক্ষেত্রে উচ্চ বৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রতিটি রাজ্যের একটি কৌশলগত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন ।
এই দুই সরকারকে কোন মূল্য শৃঙ্খল তৈরি করতে হবে তা নির্ধারণ করার জন্য 'গ্রোয়িং ইন্ডিয়া'স এগ্রিকালটারাল এক্সপোর্টস থ্রু ক্রপ-স্পেসিফিক, স্টেট-লেড প্ল্যানস' শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের রিপোর্টটি পড়তে পারেন, যা 2020 সালের জুলাই মাসে 15তম অর্থ কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছিল । এর পাশাপাশি, রাজ্যগুলি কী কৌশলগত দিক গ্রহণ করতে পারে, তার একটি সমৃদ্ধ উৎস হল 2018 সালের ডিসেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রকের প্রকাশিত কৃষি রফতানি নীতি ।
তথ্য থেকে জানা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম রফতানির জিনিস হল মাংস যা 101 বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 12 শতাংশ শেয়ার রয়েছে ৷ অথচ ভারতের শেয়ার সেখানে মাত্র 1.6 শতাংশ । প্রক্রিয়াজাত মৎস্য ও সামুদ্রিক খাবারের বাজার 97 বিলিয়ন ডলারের, যার মধ্যে চিনের 14.5৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ৷ সেখানে ভারতের শেয়ার 4.6 শতাংশ । এরপর, দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার 78 বিলিয়ন ডলারের, যেখানে নিউজিল্যান্ডের 14.3 শতাংশ শেয়ার রয়েছে ৷ সেখানে ভারতের শেয়ার 0.3 শতাংশ ৷
প্রক্রিয়াজাত ফল ও সবজির বাজার 52 বিলিয়ন ডলারের ৷ সেখানে চিন 15.6 শতাংশের শেয়ার নিয়ে শীর্ষে ৷ ভারতের শেয়ার মাত্র 0.9 শতাংশ । এরপরই রয়েছে 25 বিলিয়ন ডলারের পোল্ট্রি ও ডিমের বাজার, যেখানে ব্রাজিল 22 শতাংশ শেয়ার নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করে আছে এবং ভারতের শেয়ার সেখানে মাত্র 0.2 শতাংশ । এই ধরনের তথ্য ভালো ভাবে দেখে নেওয়া এবং সুযোগগুলিকে চিহ্নিত করা দুটি রাজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
দীর্ঘ উপকূল থাকায় অন্ধ্রপ্রদেশে চিংড়ি উৎপাদন লাভজনক হতে পারে ৷ উভয় রাজ্যেই দুগ্ধজাত পণ্য রয়েছে । তেলেঙ্গানায় মুরগি ও ডিমের জোগান খুবই ভালো । উভয় রাজ্যেই ফল ও সবজি চাষ করা হয় । উভয়ের জন্যই বাফেলো মিট যথেষ্ট সম্ভাবনাময় ৷ এই বাজারে এখন দুটি রাজ্যের অবস্থান ঠিক কী ?
বর্তমানে, ভারতের কৃষিপণ্য রফতানিতে চাল এবং চিংড়ির প্রাধান্য রয়েছে । যদি আমরা রোপণের সময় প্রচুর পরিমাণে জল ব্যবহার করে চাল উৎপাদন করি, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে রফতানি কি একটি টেকসই কৌশল হতে পারে ? আমাদের কি রোপণ এবং রফতানির উদ্দেশ্যে জল জমিয়ে না রেখে চাল উৎপাদনের উপর মনোযোগ দেওয়া উচিত ?
ভারতীয় রফতানির 70 শতাংশ মূলত নিকটবর্তী বাজারে যাচ্ছে, যেগুলো উচ্চমূল্যের বাজার নয় । মূল্যবান বাজার হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অন্যান্য উন্নত দেশ, যেখানে আমাদের রফতানির মাত্র 30 শতাংশ এখন যাচ্ছে । এটাই আমাদের লক্ষ্য করা উচিত । অন্যান্য উচ্চ-রফতানিকারী দেশগুলি থেকে আমাদের শিখতে হবে যে, কীভাবে বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় । মহারাষ্ট্রের আঙুর বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । সঠিক বাজারকে টার্গেট করে উৎপাদনশীলতা এবং গুণমানের উপর মনোযোগ দিয়ে, এফপিও (সহ্যাদ্রি ফার্মস)-র সঙ্গে কাজ করে, ব্র্যান্ডেড প্যাকেজিং এবং অনুরূপ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে ।
এই প্রতিবেদনে 22টি মূল্য শৃঙ্খল চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলিতে ভারত মূলত রফতানি বাজারের জন্য মনোনিবেশ করতে পারে । এর মধ্যে সাতটিকে উচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । এগুলি নির্বাচনের সময় বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা, রফতানি মূল্য, সম্ভাব্যতা এবং অন্যান্য বেশকিছু দিক খতিয়ে দেখা হয় ৷ দুটি তেলুগু রাজ্যকে একই মানদণ্ড ব্যবহার করতে হবে এবং তাদের নিজ নিজ রাজ্যের জন্য পছন্দের মূল্য শৃঙ্খল নির্বাচন করতে হবে ।
চিহ্নিত কিছু মূল্য শৃঙ্খল হল চাল, চিংড়ি, ফল ও সবজি, মহিষের মাংস, মশলা, কাজু বাদাম, বাদাম, নারকেল, মধু, কলা, কাঁচা তুলো এবং আম - আমাদের দুটি রাজ্যের জন্য আগ্রহের বিষয় হতে পারে । উপরে তালিকাভুক্ত মানদণ্ডের ভিত্তিতে রাজ্যগুলি রফতানি উন্নয়নের জন্য হাঁস-মুরগি ও ডিম, দুগ্ধজাত পণ্য ইত্যাদির মতো অন্যান্য পণ্যও চিহ্নিত করতে পারে । জৈব খাদ্য রফতানি, প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা খাদ্য রফতানি এবং অনুরূপ বিশেষ ক্ষেত্রগুলিও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে । দেশীয় বাজারের জন্যও সমান আকর্ষণীয় কিছু পণ্য থাকতে পারে, যা গ্রহণ করা যেতে পারে ।
উৎপাদনের জন্য ক্লাস্টার গঠন, উৎপাদনশীলতা এবং গুণমান বৃদ্ধির জন্য আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মূল্য সংযোজনের সুযোগ প্রদান ও স্থিতিশীল নীতি সহায়তা প্রদান এই ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এই সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য একটি 10 বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা থাকতে হবে । এটি রাতারাতি ঘটবে না । 2030 সালের মধ্যে কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য দুটি রাজ্যকেই এই বিষয়টিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে ।
(ডিসক্লেইমার: এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারতের মতামতকে প্রতিফলিত করে না)