লিখেছেন অপর্ণা রায়, ফেলো অ্যান্ড লিড, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্য়ান্ড এনার্জি, ওআরএফ
চিনে ছড়িয়ে পড়েছে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) ৷ এর থেকে ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে ৷ যদিও 2001 সাল থেকে ভারতে এইচএমপিভি-তে অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন ৷ আর এই রোগ এখনও পর্যন্ত স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কোনও জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেনি ৷ কিন্তু সংক্রমণের সাম্প্রতিক তথ্য থেকে উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে ৷ সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, 2024 সালে এইচএমপিভি-র সনাক্তকরণ 36 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে ।
এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে লক্ষণ সাধারণ জ্বরের মতো হয় ৷ এই ভাইরাস গুরুতর শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে ৷ বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট বেশি হতে পারে । তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় আরও একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে ৷ তা হল - জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ধরনের সংক্রমণের ঘটনা ও তীব্রতা আরও বেড়ে যাচ্ছে ।
আমেদাবাদের সিভিল হাসপাতালে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) পুরুষ ওয়ার্ডের একটি দৃশ্য। (এএনআই) জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রামক রোগকে মহামারীতে পরিণত করছে ৷ এই ধরনের রোগের বিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করছে । ক্রমশ বাড়তে থাকা তাপমাত্রা, অনিয়মিত আবহাওয়ার ধরন এবং বর্ধিত আর্দ্রতা ভাইরাসের স্থায়িত্ব ও সংক্রমণের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে শীত উষ্ণ তাপমাত্রা ও দীর্ঘায়িত বর্ষাকাল ভারতে জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ ৷ এর জেরে সংক্রামক রোগের সংখ্যা বাড়ছে ৷ প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর ৷
শ্বাসযন্ত্রে প্রভাব ফেলে এমন অনেক ভাইরাসের মতো এইচএমপিভি-ও এই পরিবর্তনশীল পরিবেশগত পরিস্থিতিতে বৃদ্ধি পায় । নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ-এ প্রকাশিত গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ঋতুচক্রের পরিবর্তন ভাইরাস সংক্রমণের সময় পরিবর্তন করছে ৷ এর ফলে অফ-সিজনে (যে সময় সংক্রমণ হওয়ার কথা নয়) সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বাড়ছে । শহুরে বস্তি, গ্রামীণ এলাকা এবং ঘন ঘন জলবায়ু বিপর্যয়ের সম্মুখীন অঞ্চলগুলির ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতিরিক্ত জনবসতি, দুর্বল নিকাশি ব্যবস্থা ও সীমিত স্বাস্থ্য পরিষেবার কারণে অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব পড়ছে সংক্রমণে ৷
প্রয়াগরাজের একটি মেডিক্যাল সেন্টারে একজন ডাক্তার একজন ব্যক্তির রক্তের নমুনা নিচ্ছেন৷ (এএনআই) এই স্পষ্ট যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও এইচএমপিভি ও অনুরূপ রোগকে রুখতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভারতের তরফে খুবই কম পদক্ষেপ করা হয়েছে ৷ এমনকী, জলবায়ু পরিবর্তনকে এই রোগের সংক্রমণ কমানোর কর্মসূচির সঙ্গে মেলানোও হয়নি ৷ ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ সার্ভিলিয়েন্স প্রোগ্রাম (আইডিএসপি)-এর মতো জাতীয় কর্মসূচিগুলি সংক্রামক রোগ পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে ৷ কিন্তু প্রায়শই প্রাদুর্ভাবের কারণ পরিবেশগত চাপ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় এই কর্মসূচি । একই ভাবে, ভারতের জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জাতীয় কর্মসূচি, যার নাম ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হিউম্যান হেলথ (এনএপিসিসিএইচএইচ) জলবায়ু-সংবেদনশীল অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে ৷ কিন্তু তাদের কাছে এইচএমপিভি-র মতো শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস মোকাবিলার নির্দিষ্ট কৌশলের অভাব রয়েছে ।
সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যগুলিতে নজরদারি বৃদ্ধি করলে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে না । ভারতকে জরুরিভাবে একটি আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যা জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা ও দুর্যোগ মোকাবিলা সংক্রান্ত নীতিগুলিকে এইচএমপিভি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিক্রিয়ার কৌশলের সমস্ত দিকগুলিতে একত্রিত করে ৷ যার মধ্যে পর্যবেক্ষণ, রোগ নির্ণয় ও পরিকাঠামো অন্তর্ভুক্ত থাকবে ৷ তার সঙ্গে থাকবে আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও ক্ষমতার ঘাটতি পূরণ করার বিষয়গুলিও ।
বর্তমানে ভারতে সংক্রামক রোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার নীতিগুলি গয়ংগচ্ছভাবে কাজ করে ৷ যার ফলে বিভাজিত কৌশল তৈরি হয় ৷ এর ফলে সংক্রামক রোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল সম্পর্ক মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় । উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে এনএপিসিসিএইচএইচ-এর মতো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কর্মসূচি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তৈরি অসুস্থতা কমাতে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উপর জোর দেয় ৷ তবে এটা বৃহত্তর জলবায়ু সংক্রান্ত কারণগুলিকে উপেক্ষা করে ৷ যেমন - ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও দীর্ঘায়িত আর্দ্রতা ৷ অথচ এগুলিই এইচএমপিভি-র মতো শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের বিস্তার ও স্থায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে । একই ভাবে, রাজ্যগুলির জলবায়ু সংক্রান্ত পরিকল্পনায় খুব কমই স্বাস্থ্যের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৷ এর জেরে পুরো বিষয়টির উপরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবধান তৈরি হয় ।
চেন্নাইয়ের ডিরেক্টরেট অফ মেডিক্যাল অ্যান্ড রুরাল হেলথ সার্ভিসেস (ডিএমএস) ক্যাম্পাসে জিনোম সিকোয়েন্সিং ল্যাব ও আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে কর্মরত একজন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী। (এএনআই) কার্যকর জলবায়ু-স্থিতিশীল স্বাস্থ্য কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণের সঙ্গে রোগ ছড়িয়ে পড়ার অঞ্চলের সমন্বয় করতে পারে এমন ডেটাবেসের অভাব ৷ বেশিরভাগ রাজ্যে জলবায়ু ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নজরদারির সমন্বয়ের অভাব রয়েছে ৷ এই সমন্বয় থাকলে পরিবেশগত পরিস্থিতি ও শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার বিস্তারের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজা সহজ হতো ৷ এছাড়া প্রাদুর্ভাবের ধরনগুলি পূর্বাভাস দেওয়া, দক্ষতার সঙ্গে সম্পদ বরাদ্দ করা বা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সংক্রমণ আটকানোর ব্যবস্থা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
ঘরে বসে ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে ভারত তার স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় বিপ্লব আনতে পারে । পরিধানযোগ্য শারীরবৃত্তীয় সেন্সর, স্মার্ট ইনহেলার এবং এরিয়াল টেমপারেচার ট্র্যাকার-এর মতো উদ্দেশ্য-নির্মিত স্মার্টফোন অ্যাপগুলি রিয়েল-টাইম ডেটা তৈরি করতে পারে, যা পরিবর্তিত জলবায়ু প্যাটার্নের মুখে অভিযোজিত শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কৌশলগুলিকে অবহিত করে । ভারতজুড়ে সম্ভাব্য এইচএমপিভি-র প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা জরুরি ৷ সেই কারণে, ভারতের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করে ভবিষ্যতের পরিস্থিতির বিশ্লেষণ তৈরি করতে পারে এমন উন্নত গবেষণা সংক্রান্ত সুবিধাগুলি গড়ে তোলা অপরিহার্য ৷ এটা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এইচএমপিভি-র প্রাদুর্ভাবের হটস্পট সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে, যা পূর্ব-প্রতিক্রিয়াশীল হস্তক্ষেপগুলিকে নির্দেশিত করতে পারে ।
আমেদাবাদের সিভিল হাসপাতালের হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি)-এর আইসোলেশন ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ভেতরে চিকিৎসা সরঞ্জাম-সহ হাসপাতালের কর্মী। (এএনআই) দুর্ঘটনা-পরবর্তী চিকিৎসা থেকে রোগের সক্রিয় প্রতিরোধে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তরের জন্য বাস্তবসম্মত একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রয়োজন । ভারতের বিদ্যমান পরিকাঠামো নিয়মিত চাহিদা মেটাতেই লড়াই করে৷ তাই জলবায়ু-চালিত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতি সামলানো কঠিন এই পরিকাঠামোর পক্ষে ৷ ভারতে প্রতি এক হাজার জনের জন্য হাসপাতালে বেডের সংখ্যা মাত্র 0.5 এবং প্রতি 1511 জনের জন্য মাত্র একজন ডাক্তার রয়েছে । গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত পেশাদার ব্যক্তিদের ঘাটতি রয়েছে ৷ সেখানে প্রতি 10 হাজার জনে মাত্র 3.2টি বেড সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ।
এই পদ্ধতিগত অপ্রতুলতার কারণে ভারত এইচএমপিভি-র মতো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের অতিরিক্ত বোঝা মোকাবিলা করার জন্য অপ্রস্তুত । স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত সুবিধার সম্প্রসারণ, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ এলাকায় ও জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগ সনাক্তকরণ ও চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ ৷ এটাই হোক প্রথম পদক্ষেপ । জেলা হাসপাতালগুলিকে উন্নত ডায়াগনস্টিক সরঞ্জাম দিয়ে বাড়তে থাকা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলির জন্য প্রস্তুতি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
চিনে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) প্রাদুর্ভাব নিয়ে একজন শিল্পকলা শিক্ষক একটি ক্যানভাসে আঁকছেন। মুম্বইয়ে৷ (এএনআই) পরিশেষে, জলবায়ু থেকে তৈরি হওয়া শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সহযোগিতামূলক পদ্ধতির প্রয়োজন, যা কেবলমাত্র সরকারি প্রচেষ্টার বাইরেও যেতে পারে । ঠিক যেমন আশা কর্মীরা মাতৃ ও শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনই ভাইরাল প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় একই ধরনের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের কমিউনিটি ক্যাডারদের একত্রিত করা যেতে পারে । জলবায়ু সংক্রান্ত কারণগুলির সঙ্গে যুক্ত শ্বাসকষ্টের প্রাথমিক লক্ষণগুলি সনাক্ত করার জন্য প্রশিক্ষিত এই ক্যাডারদের মাঠে নেমে কাজ করাতে হবে ৷ তবেই সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে ৷
এইচএমপিভি হয়তো কেবল একটি ভাইরাস, কিন্তু এটি জলবায়ু-সংবেদনশীল স্বাস্থ্য সংকটের একটি বৃহত্তর প্রবণতার প্রতীক, যা আরও তীব্রতর হবে। জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনায় জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের কাছে তার নাগরিকদের উষ্ণায়নের প্রভাব থেকে রক্ষা করার সুযোগ রয়েছে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)