আর সপ্তাহখানেক পরই দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচন ৷ ভোটের সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই জাতীয় রাজধানীতে নির্বাচনী প্রচার তীব্রতর হচ্ছে । দিল্লিতে বিধানসভার আসন সংখ্যা 70 ৷ এবারের নির্বাচনে আম আদমি পার্টি (আপ), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও কংগ্রেসের মধ্যে তীব্র ত্রিমুখী লড়াই চলছে । ‘দিল্লি কা দিল’ (দিল্লির মন) জয়ের জন্য এই তিন দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হচ্ছে ৷ সেই লড়াইয়ে জিততে রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন ধরনের শোভন ও অশোভন উভয় কৌশলই ব্যবহার করছে ।
দিল্লিতে শেষবার বিজেপি সরকার গড়েছিল 1998 সালে ৷ পরের 27 বছর সেখানে বিজেপি আর জিততে পারেনি ৷ এবার হারের ধারা ভাঙতে চাইছে তারা ৷ দিল্লিতে কংগ্রেসের সরকার ছিল 1998 সাল থেকে 2013 সাল পর্যন্ত ৷ শীলা দীক্ষিতের সেই শাসনকালে জাতীয় রাজধানীর রাজনৈতিক ইতিহাসে কংগ্রেস যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, প্রচারে তারা সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ৷ ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি আত্মপ্রকাশের 48 দিনের মধ্যে 2014 সালে ভোটে জয়ের নজির তৈরি করতে পেরেছিল ৷ তবে এবার তাদের ঘিরে রয়েছে একাধিক বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ ৷
আগামী 5 ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে ভোটগ্রহণ ৷ 8 ফেব্রুয়ারি ফলাফল ঘোষণা করা হবে । বিজেপি ও আপের প্রচারের তীব্রতা আপাতদৃষ্টিতে কংগ্রেসের তুলনায় বেশি বলে মনে হচ্ছে । প্রচারে পিছিয়ে থাকলেও কংগ্রেস আপের উপর প্রভাব ফেলতে পারে ৷ কারণ, তারা আপের ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে পারে ৷
নির্বাচনী সমাবেশগুলিতে ভোটারদের নজর টানতে ইদানীং ‘হোয়াটাবাউটিজম’ (প্রতিপক্ষের তোলা প্রশ্নের উত্তরের বদলে পালটা প্রশ্ন তোলা)-এর বেশি ব্যবহার হচ্ছে ৷ প্রতিপক্ষকে অসম্মানিত করতে ও ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে দলগুলি নির্লজ্জভাবে একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করছে । বিজেপি, কংগ্রেস ও আপের তারকা প্রচারকরা একে অপরের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ব্যস্ত । সমস্ত বড় বড় নেতারা নিজেদের বাগ্মীতা ও বর্ণনার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখাতে ব্যস্ত ৷ তাঁরা যে অভিযোগ করছেন, তার কিছু প্রমাণিত ও কিছু অপ্রমাণিত ।
বিজেপি-কে জয়ী করলে যে দিল্লিবাসীর জীবন আমূল পরিবর্তন ঘটবে, তা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন গেরুয়া শিবিরের নেতারা ৷ দিল্লিতে বিজেপির সভাপতি বীরেন্দ্র সচদেব সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ৷ সেই নিয়ে নথিপত্রও দেখান । আপ সরকার পরিচালিত মহল্লা স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলিতে কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে, এই দাবি করতে গিয়ে জেপি নাড্ডা স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সরকারি পদের কথা উল্লেখ করেন । নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশের সময় বিজেপি অনুরাগ ঠাকুর আপের যোজনাগুলির থেকে আরও বেশি কল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেন ।
প্রতিটি ভোটে বিজেপির প্রচারের মুখ্য বিষয় হয় হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা ৷ আগের নির্বাচনগুলির মতো এবার দিল্লির নির্বাচনে তা তীব্রভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না ৷ যে বিজেপি কেজরিওয়াল ও তাঁর দলকে 'চুনাভি হিন্দু' (ভোটের সময় হিন্দুত্ববাদী হওয়া) বলে ব্যঙ্গ করত, তারা এখন উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর অধিকারের কথা বলছে ।
আম আদমি পার্টির কথা বলতে গেলে, তাদের প্রধান নিজের ঢাক পেটাতে ব্যস্ত ৷ সমর্থকদের প্রতি প্রচুর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন এবং দিল্লিতে যা কাজ হয়েছে, সবকিছুর জন্য নিজের কৃতিত্ব দাবি করেছেন ৷ এর বদলে সমর্থনও চাইছেন ৷ পাটপরগঞ্জ বিধানসভা আসনে 2020 সালে মণীশ সিসোদিয়া 3 হাজার ভোটে জিতেছিলেন ৷ সেখানে একটি সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতার শুরুতেই সমর্থকদের সংখ্যা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন কেজরিওয়াল ৷ যদিও সিসোদিয়া এবার এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না, তার পরও ওই আসন জয়ের জন্য কেজরিওয়াল সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করছেন ৷ ওই আসন ধরে রাখতে ইউপিএসসি-র শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া আওধ ওঝাকে বেছে নিয়েছেন তিনি ।
সিসোদিয়া এবার জঙ্গপুরা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৷ সেখানে 2020 সালে জিতেছিলেন প্রবীণ কুমার ৷ তিনি 50 শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন ৷ সিসোদিয়া বিজেপির তারবিন্দর মারওয়া ও দিল্লির প্রাক্তন মেয়র কংগ্রেসের ফারহাদ সুরির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন । এই আসনে গত তিনবার জিতেছে আপ ৷
কেজরিওয়াল সমাবেশে যা বলছেন, তার বেশিরভাগই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অতিশী পুনরাবৃত্তি করছেন । কেজরিওয়াল যে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি করেছেন, সেই বিষয়টি প্রচারে তুলে ধরেছেন তিনি ৷ তাঁর দেওয়া স্লোগান "কেয়া আপ কো মুফত বিজলি মিলতি হ্যায় (আপনি কি বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পান?)"-এর প্রতিদানে আপ-কেই সমর্থন করেন ভোটাররা, সেটাও তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন ৷
কেজরিওয়ালের বিখ্যাত পদত্যাগের পর মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন অতিশী ৷ তিনি দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির কালিকাজি বিধানসভা আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন । তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরাও হেভিওয়েট ৷ এই নেতাদের মধ্যে রয়েছেন বিজেপির রমেশ বিধুরী, যিনি দক্ষিণ দিল্লির দু’বারের সাংসদ এবং তিনবারের বিধায়ক ৷ সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের প্রধান অলকা লাম্বা ওই আসনে প্রার্থী হয়েছেন ৷ তিনি আবার 2015 সালে চাঁদনী চক থেকে আপের টিকিটে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন ৷ 2019 সালে তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেন ।
জনসভায় রাজনীতিবিদদের বক্তৃতার বিষয়বস্তু বিবেচনা করে বলা যায় যে নির্বাচন ক্রমশ অপ্রত্যাশিত ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে । বিজেপি নেতারা প্রচারপর্বে নিজেদের বক্তৃতায় ধারাবাহিকভাবে আপ সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগের উপরই জোর দেওয়া হচ্ছে । বিজেপি তিনটি নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে ৷ প্রথমটি অনুরাগ ঠাকুর, দ্বিতীয় জেপি নাড্ডা এবং তৃতীয় অমিত শাহ প্রকাশ করেন ৷ সেখানে যে কল্যাণমূলক প্রতিশ্রুতিগুলি দেওয়া হয়েছে, তা অনেকটা আপের কল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলির মতোই ৷
বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির পালটা জবাবও দিচ্ছেন কেজরিওয়াল ৷ একটি সমাবেশ থেকে তিনি উল্লেখ করেছেন যে কীভাবে উত্তর প্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে ৷ বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে আপ সরকারের চালু করা কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি ভেস্তে দেবে বলেও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । কেজরিওয়ালের বক্তব্যের পর আশঙ্কা দূর করার জন্য অমিত শাহ স্পষ্ট করে বলেছেন যে বিজেপি এখন যে প্রকল্পগুলি রয়েছে, তা চালিয়ে যাবে । কারোলবাগে একটি সমাবেশে যোগী আদিত্যনাথ কেজরিওয়ালকে ‘মিথ্যার এটিএম’ বলে কটাক্ষ করেছেন । তিনি দিল্লির দূষিত যমুনা ও উত্তর প্রদেশের গঙ্গার মধ্যে তুলনাও করেছেন, যেখানে তীর্থযাত্রীরা পবিত্র স্নান করেন ।
তিনি বিজেপি প্রার্থী দুষ্মন্ত গৌতমের সমর্থনে প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন ৷ যিনি আপের বিশেষ রবি ও কংগ্রেসের রাহুল ধনকের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন । বিশেষ রবি আগের দু’টি নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীকে উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে হারিয়েছেন ৷ এবার বিজেপি দুষ্মন্তকে প্রার্থী করেছে এই আশায় যে তিনি হয়তো পরিস্থিতি পালটে দিতে পারবেন । শাকুর বস্তি আসনে বিজেপি দলের দিল্লি মন্দির সেলের প্রধান কর্নাইল সিংকে প্রার্থী করেছে । তাঁর মুখোমুখি তিনবারের আপ বিধায়ক সত্যেন্দ্র জৈন । দিল্লির ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির জন্য 2022 সালে এই সেলটি গঠিত হয়েছিল ।
নাড্ডা নিজেই কর্নাইল সিংয়ের সমর্থনে প্রচার করেছেন ৷ এর ফলে বোঝা যাচ্ছে এই আসনের গুরুত্ব কতটা ৷ কর্নাইল সিং নিজেকে সনাতন ধর্মের সেবক বলে অভিহিত করেন । শাকুর বস্তিতে নাড্ডা যে প্রচারে অংশ নেন, সেখানে তাঁর বক্তব্য কেজরিওয়াল কেন্দ্রীক ছিল ৷
কংগ্রেসের অবস্থা ভালো নয়, এই পরিস্থিতিতে বিজেপি এবং আপ একে অপরকে অবমাননা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ৷ তারা মনে করছে যে এভাবেই তারা ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে পারবে ৷ 5 ফেব্রুয়ারি ভোটাররা ন্যায্যতা ও অতিরঞ্জনের মধ্যে পার্থক্য করবেন । দেওলি বিধানসভা কেন্দ্রের এক সমাবেশে অতীশি ঠিকই বলেছিলেন, "আপনি একদিন ভোট দেন এবং এর প্রভাব পাঁচ বছর পর্যন্ত থাকে ।"
