সম্প্রতি ডাচ লোকেশন টেকনোলজি ফার্ম 500টি শহরের ট্র্যাফিক ইনডেক্স র্যাঙ্কিং প্রকাশিত করেছে ৷ সেখানে কলকাতাকে বিশ্বের দ্বিতীয় মন্থর শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । গত বছর কলকাতায় 10 কিলোমিটার যাওয়ার গড় সময় ছিল 34 মিনিট 33 সেকেন্ড ।
বেঙ্গালুরু, পুনে, হায়দরাবাদ ও চেন্নাই-সহ আরও বেশ কয়েকটি ভারতীয় শহর যানজটপূর্ণ শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে । ভারতে যেভাবে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে এটাকে খুব একটা অবাক করার মতো কিছু নয় বলেই মনে হয় । 1901 সালে 25.9 মিলিয়ন থেকে 2011 সালে ভারতীয় শহরগুলির জনসংখ্যা 14 গুন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা 2011 সালে 37.1 মিলিয়নে পৌঁছেছে । বর্তমানে যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে 2050 সালে ভারতীয় শহরগুলিতে জনসংখ্যা 870 মিলিয়নে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে ।
যানজটের সমস্যার কারণ
রোড ট্রান্সপোর্ট ইয়ারবুক 2019-20 অনুযায়ী, প্রতি 1000 জন পিছু মোটরগাড়ির সংখ্যা 2001 সালে 53টি ছিল, যা 2020 সালে বেড়ে 246টিতে দাঁড়িয়েছে । মোটরচালিত যানবাহনের সংখ্যা (গাড়ি ও দ্বিচক্রযান) রাস্তায় চলা মোট গাড়ির 85 শতাংশ । তবে, ভারতীয় শহরগুলিতে পরিবহণের চাহিদা ও এর সংখ্যার মধ্যে অসঙ্গতি রয়েছে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দিল্লিতে রাস্তার 90 শতাংশ জায়গা গাড়ি ও বাইক বা স্কুটি দখল করে রেখেছে ৷ যা রাস্তায় যাতায়াত করা মানুষের চাহিদার 20 শতাংশও পূরণ করে না ।
গণপরিবহণ ব্যবস্থার একাধিক সুবিধা রয়েছে৷ যেমন প্রতি যাত্রীর জন্য রাস্তার কম জায়গা ব্যবহার করে, জ্বালানি খরচ কম এবং দূষণ কম । তবুও, নীতি আয়োগ 2018-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে প্রতি এক হাজার জনে মাত্র 1.2টি বাস রয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলির মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম । দেশের 458টি শহর, যেখানে জনসংখ্যা এক লাখের বেশি, তার মধ্যে মাত্র 63টিতে শহর কেন্দ্রীক বাস পরিষেবার ব্যবস্থা রয়েছে ।
মেট্রো ও শহরতলির রেল পরিষেবা যথাক্রমে 13 এবং 9টি শহরে রয়েছে । অপর্যাপ্ত গণপরিবহণ ব্যবস্থা এবং আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে । অটোরিকশা, ট্যাক্সি ও মিনিবাস-সহ মধ্যবর্তী গণপরিবহণ অবশ্য মাঝারি ও ছোট শহরে মানুষের যাতায়াতের সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে দেয় ৷
এই সমস্ত কিছু আমাদের শহরগুলিতে যানজটের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে । নীতি আয়োগ 2018-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারতীয় কিছু মেট্রো শহরে যানবাহনের গড় গতি 17 কিমি প্রতি ঘণ্টার থেকেও কম । শহরের বাসিন্দাদের সাধারণত যানজটের সময় 1.3 থেকে 1.6 গুন অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে বাধ্য করা হয় । সময়ের অপচয়ের ফলে শহরগুলিতে উৎপাদনশীলতার ব্যাপক ক্ষতি হয় ।
ভারতের চারটি শীর্ষ মেট্রো শহরে 2018 সালে যানজটের কারণে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় 22 বিলিয়ন ডলার হয়েছিল বলে অনুমান করা হয় । যানজটের প্রতিকূল প্রভাব সময় ও অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়েও বেশি । যাতায়াতের সময় ও যানজট বৃদ্ধির অর্থ দূষণকারী পদার্থের নির্গমন বৃদ্ধি করে ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে ।
‘মোবিলিটি অ্যান্ড কনজেশন ইন আরবান ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি এনবিইআর ওয়ার্কিং পেপার (2018) ভারতের 154টি শহরের 22 মিলিয়ন যাতায়াত (ট্রিপ) বিশ্লেষণ করেছে ৷ সেখানে দেখা গিয়েছে যে ভারতীয় শহরগুলিতে যানজটহীন গতিশীলতা (অর্থাৎ রাস্তায় একাধিক বাধা মোকাবিলা করার পরে যানবাহন যে গতিতে চলাচল করে) একটি গুরুতর সমস্যা । নয়াদিল্লিতে যানবাহনের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় 15 কিমি ৷ যানজট কমানোর পরেও তা প্রতি ঘণ্টায় 20 কিমি অতিক্রম করতে পারেনি ৷
এর জন্য খারাপ রাস্তা ও ত্রুটিপূর্ণ নকশাকে দায়ী করা যেতে পারে । চণ্ডীগড়ের মতো গ্রিড-সদৃশ সড়ক নেটওয়ার্ক-সহ শহরগুলিতে যান চলাচল তুলনামূলকভাবে দ্রুতগতিতে হয় । মেট্রো ছাড়া অন্য শহরগুলিতে যানবাহন চলাচলের কম গতির সমস্যা আরও তীব্র ৷ কারণ, সেখানে থাকা সড়ক নেটওয়ার্কগুলি দ্রুত ক্রমবর্ধমান যানবাহন চলাচলের জন্য অক্ষম । এতে শহরের গরিবরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ৷ কারণ, তাঁরা গণপরিবহণ ব্য়বহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন ৷ এর ফলে শহরগুলিতে অসাম্য তৈরি হচ্ছে ৷
যানজট সমস্যার সমাধান
শহরগুলিতে মানুষের চলাচলের ধরন পুনর্বিবেচনা করা ও সেই অনুযায়ী নীতিগত বিকল্পগুলি তৈরি করা দরকার ৷ এটা করার জন্য এখনও খুব বেশি দেরি হয়নি । এর জন্য গণপরিবহণকে শক্তিশালী করা থেকে শুরু করা উচিত, যাতে শহরের মধ্যে চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত পরিবহণের উপর মানুষের নির্ভরতা হ্রাস পায় । যাত্রীদের সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন । যোগাযোগ ব্যবস্থাকে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত উন্নত করা ও সকল মানুষের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য পরিবহণ পরিষেবা ডিজাইন করা অপরিহার্য । অনেক ভারতীয় শহরে বহুল প্রচারিত মেট্রো পরিষেবাগুলি শেষপ্রান্ত পর্যন্ত না পৌঁছানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । সকলেই যাতে সুরক্ষিতভাবে যাতায়াত করতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে ৷
পথচারীদের জন্য ও সাইকেল চলতে পারে এমন পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে ৷ এর ফলে অ-মোটরচালিত পরিবহণ, যেমন - হাঁটা এবং সাইকেল চালানোর বিষয়ে মানুষ উৎসাহিত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন ঘটাতে পারে ৷ এটা কেবল যান চলাচলকে দ্রুততর করবে না, বরং দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কমিয়ে দেবে । রাস্তার পরিকাঠামো উন্নত করার জন্য জনসাধারণের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ।
শহরের বিভিন্ন অংশে ও একই শহরের মধ্যে দিনের বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণের ধরন চিহ্নিত করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ । পরিবহণ নেটওয়ার্কের দক্ষতা উন্নত করার জন্য নীতিনির্ধারকদের ভ্রমণের তথ্য প্রয়োজন । প্রযুক্তি-ভিত্তিক রিয়েল-টাইম ভ্রমণের তথ্য থাকলে, তা যানজট নিয়ন্ত্রণ এবং গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে কার্যকরী হতে পারে ।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ঘণ্টাভিত্তিক গড় যানবাহনের সংখ্যা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ ট্র্যাফিক সিগন্যালের সময় পুনর্নির্মাণ এবং স্বয়ংক্রিয় করতে সফল হয়েছে, যার ফলে ভ্রমণের সময় 13 মিনিট হ্রাস পেয়েছে ।
পরিশেষে, একাধিক পরিবহণ পরিষেবা প্রদানকারী একটি শহরের মধ্যে কাজ করে । সমন্বিত পরিবহণ পরিকল্পনার উপর মনোযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুট ও ভাড়ার কাঠামো নির্ধারণের জন্য সু-সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন । এর ফলে সকলের জন্য কার্যকর নগর পরিবহণ ব্যবস্থা তৈরি করতে ব্যবহারকারীদের সম্পৃক্ততাও প্রয়োজন ।