চিনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া গত 25 ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত করেছে ৷ সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, চিন ইয়ারলুং সাংপো (ব্রহ্মপুত্র) নদীর নিম্ন প্রান্তে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে । নদীটি তিব্বতে উৎপন্ন হয়ে ভারত ও বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে ।
এই প্রকল্পের জন্য 137 বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে ৷ প্রস্তাবিত ইয়ারলুং সাংপো বাঁধটি হবে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পরিকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প । অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই বাঁধটি চিনের স্থায়ী শক্তির সন্ধানে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ ৷ তাছাড়া এটা ইঞ্জিনিয়রিং ক্ষেত্রে একটি বিশাল কীর্তি হবে ।
দুর্ভাগ্যবশত, এই বিস্ময়কর ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের পরিবেশগত উদ্বেগ, সামাজিক প্রভাব ও কৌশলগত প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর ৷ বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য । ভারতে এই নদী ব্রহ্মপুত্র এবং বাংলাদেশে যমুনা নামে পরিচিত ।
ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়
চিনের প্রস্তাবিত বাঁধটি থেকে বার্ষিক প্রায় 300 বিলিয়ন কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে ৷ এই উৎপাদন চিনের 'থ্রি জর্জেস ড্যাম'-এর তিনগুণেরও বেশি, যা বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ । এই প্রকল্পটি পুনর্নবীকরণ শক্তির মাধ্যমে 2060 সালের মধ্যে চিনের পরিকল্পিত কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনে অনেকটা সাহায্য করবে ৷ ourworldindata.org এর মতে, চিন এখন বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকারী ৷ বিশ্বব্যাপী নির্গমনের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি নির্গমন করে চিন ।
ভূ-প্রকৃতিগত চ্যালেঞ্জ
নামচা বড়ুয়া এলাকার গ্রেট বেন্ড নামে পরিচিত এলাকায় ইয়ারলুং সাংপো নদী প্রায় 2000 মিটার গভীরে নেমে এসেছে, যার দৈর্ঘ্য 50 কিলোমিটার । অল্প দূরত্বে খাড়া পতনের কারণে বিপুল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে ৷ সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য ইঞ্জিনিয়রদের নামচা বারওয়া পর্বতের মধ্য দিয়ে 20 কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ চার থেকে ছয়টি সুড়ঙ্গ খনন করতে হবে । নামচা বারওয়া-গ্যালা পেরি পর্বতমালা পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় চলমান ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলির একটা অংশ ৷
খরচ ও ঝুঁকির কারণ
নির্মাণ স্থলটি ভারতীয় ও ইউরোপীয় টেকটোনিক প্লেটের সীমানার উপরে অবস্থিত । এই অঞ্চলে পরীক্ষা না করে ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল ব্যবহার করে বিশাল বাঁধ নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে ৷ এতে পুরো অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক এবং বাস্তুতন্ত্রের অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হতে পারে ।
পরিবেশগত উদ্বেগ
এই বাঁধ নির্মাণের ফলে তুলনীয় জীববৈচিত্র্যের একটি অঞ্চল তিব্বত মালভূমির ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র আরও ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে ৷ নদীর প্রবাহ ও পরিসরের ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় প্রজাতির আবাসস্থল ধ্বংস হতে পারে ৷ এই প্রজাতিগুলির মধ্যে অনেকগুলি ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের কার্যকলাপের কারণে অবলুপ্তির পথে ৷
ভারত ও বাংলাদেশের উপর প্রভাব
চিন ভারত ও বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে যে ইয়ারলুং সাংপোতে প্রস্তাবিত বাঁধটি নিচের দিকের জলপ্রবাহকে প্রভাবিত করবে না । তারা জোর দিয়ে বলেছে যে প্রকল্পটি একটি ‘নদীর প্রবাহ’ উদ্যোগ । এটা নদীর জলের সম্ভাব্য শক্তি ব্যবহার করে টারবাইনগুলিকে চালিত করার জন্য এবং ব্রহ্মপুত্র নদীতে তার প্রাকৃতিক প্রবাহকে ব্যাহত না করে ফিরিয়ে আনার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে । চিনের মতে, এই পদ্ধতিতে পরিবেশগত বা জলবিদ্যুৎগত বিপর্যয় ন্যূনতম পরিমাণের বেশি হবে না ৷ এই যুক্তি অবশ্য ভারত ও বাংলাদেশের ভয় কাটাতে পারেনি ।
মেকং নদী থেকে শিক্ষা
মেকং নদীর উপর চিনের বাঁধ পরিচালনা একটি সতর্কতামূলক ঘটনা । পরিবেশগত ক্ষতি ও জলপ্রবাহ হ্রাস বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করেছে ৷ নিচের দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা কেড়ে নিয়েছে । অতীতের এই ঘটনা ইয়ারলুং সাংপো বাঁধের সম্ভাব্য সুবিধা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করেছে ৷ নদীর নিচের অংশে যে দেশগুলি রয়েছে, সেখানে বিরূপ প্রভাব পড়বে না তো ! এই প্রশ্নই উঠছে ৷
ভারত ও বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ কৃষি, পানীয় জল এবং মৎস্য চাষের জন্য নদীর উপর নির্ভর করে । নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে খরা ও বন্যা আরও বাড়তে পারে, যা জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে ।
স্থানচ্যুতি ও পুনর্বাসন
তিব্বতের মেদোগ কাউন্টিতে ইয়ারলুং সাংপো বাঁধ নির্মাণের ফলে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে সরে যেতে হতে পারে । থ্রি জর্জেস বাঁধ নির্মাণের ফলে 13 লক্ষেরও বেশি লোককে বাস্তুচ্যুত হতে হয় ৷ তিব্বতেও একই রকম বা তার বেশি সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে । তিব্বতি বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে বাঁধ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছেন ৷ তাঁরা এটাকে শোষণমূলক উদ্যোগ হিসেবে দেখেছেন, যা তাঁদের মাতৃভূমির বিনিময়ে চিনকে লাভবান করতে চলেছে । বাঁধ নির্মাণের ফলে মঠ, প্রাচীন গ্রাম এবং পবিত্র এলাকা ডুবে যাওয়ার বা প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে । এই সাংস্কৃতিক ক্ষতি তিব্বতিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিকে আরও গভীর করতে পারে ৷ কারণ, তাঁরা ইতিমধ্যেই চিনের মধ্যে নিজেদের কোণঠাসা বলে মনে করছেন ৷
ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব
চিনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জলবণ্টন চুক্তি না থাকায় ভারত ও বাংলাদেশ এই বাঁধটিকে তাদের জল নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখছে । ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে এই নদের নিচের অংশে থাকা দেশগুলিতে কৃষি, পানীয় জল ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে চিন ।
কৌশলগত ঝুঁকি
ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত সীমান্তের কাছে তিব্বতে বাঁধটির অবস্থান প্রকল্পটিকে একটি কৌশলগত মাত্রা যোগ করেছে । ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে জল-সঙ্কটে থাকা দেশগুলির মধ্যে একটি ভারত৷ ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার চিনের ক্ষমতাকে ভারত একটি সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দেখে । এই বাঁধের পরিকল্পনা এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে ৷ বিশেষ করে ভারত ও চিনের মধ্যে চলতে থাকা সীমান্ত বিরোধের প্রেক্ষিতে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন
চিনে পরিচালিত অন্তত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে ইয়ারলুং সাংপো নদীর উপর একটি বৃহৎ বাঁধ সকল উপকূলীয় রাজ্যের জন্য উপকারী হতে পারে, যদি তা সহযোগিতামূলকভাবে পরিচালিত হয় ৷ এর ফলে শুষ্ক মরসুমে জলপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে । তবে, দেশগুলির মধ্যে অবিশ্বাসের কারণে এই ধরনের সহযোগিতা অসম্ভব । ভারত ও বাংলাদেশের চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সংলাপ ও ঝুঁকি কমানোর জন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে ৷
চিনের কৌশলগত লক্ষ্যে পরিকাঠামোর ভূমিকা
ইয়ারলুং সাংপো বাঁধটি প্রকৌশল ও পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানিতে বিশ্বনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে । যদিও বাঁধটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল বিদ্যুৎ উৎপাদন ৷ এই বাঁধের নির্মাণ তিব্বতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও উদ্দীপিত করবে ৷ যদিও উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনও হবে । এই প্রকল্প চিনের বৃহত্তর কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ৷ যার মাধ্যমে তিব্বতকে জাতীয় অর্থনীতিতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংহত করা সম্ভব হবে ৷ কেন্দ্রীয় ভর্তুকির উপর নির্ভরতা হ্রাস করা সম্ভব হবে ।
অস্ত্র হিসেবে জলের ব্যবহার
কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে বাঁধটির অবস্থান দ্বৈত উদ্দেশ্যকে তুলে ধরে: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব । এর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে চিন উল্লেখযোগ্য সুবিধা অর্জন করবে । সংঘাতের সময় চিন জলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ৷ এটা গুরুতর উদ্বেগের বিষয় ৷ প্রচুর পরিমাণে জল ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে চিন ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করতে পারে ৷ অসামরিক জীবন ব্যাহত করতে পারে এবং ভারতে গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোগত ক্ষতি করতে পারে । উপরন্তু, এই ধরনের পদক্ষেপ সরবরাহ শৃঙ্খল অস্থিতিশীল করবে, লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে ও অরুণাচল প্রদেশের মতো সংবেদনশীল অঞ্চলে দুর্বলতা বৃদ্ধি করবে ৷ ফলে সীমান্ত এলাকায় ভারতের সামরিক অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে । এই দ্বৈত ক্ষমতা বাঁধটিকে চিনের জন্য কৌশলগত সম্পদে পরিণত করবে ।
উপসংহার
ইয়ার্লুং সাংপো বাঁধ আধুনিক পরিকাঠামোর বৈপরীত্যের প্রতীক হতে চলেছে: মানুষের দক্ষতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রমাণ, তবে গভীর পরিবেশগত, সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের উৎসও । যদিও এটা চিনের জ্বালানির পরিসরকে রূপান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ৷ তবে এটা তৈরিতে আর্থিক খরচ, পরিবেশগত ও কৌশলগত লাভ অপরিসীম । ভারত ও বাংলাদেশের জন্য প্রকল্পটি জল নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি সম্ভাব্য হুমকি । নির্মাণের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাঁধের সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলি হ্রাস করার জন্য সহযোগিতা ও স্থায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া সকল অংশীদারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)