নয়াদিল্লি, 10 জুলাই: কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল মাওইস্ট-সেন্টার (সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টার)-এর নেতা তথা নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দহল নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি জোট সরকারের ৷ যে সরকারের সবচেয়ে বড় শরিক ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট (সিপিএন-ইউএমএল) ৷ এই দল সমর্থন প্রত্যাহারের কথা জানানোর পর পুষ্প কুমার দহল (এছাড়াও তিনি দে গুয়েরে প্রচণ্ড নামেও পরিচিত) সংবিধানকে হাতিয়ার করে নতুন খেলা শুরু করেছেন ৷
প্রচণ্ড আগেই জানিয়েছেন যে তিনি নেপালের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরবেন না ৷ বরং আস্থাভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি ৷ এই পরিস্থিতিতে তাঁর কৌশল নেপালি কংগ্রেসের সেই অংশকে নিজের দিকে টেনে আনা, যা একসময় তাঁর জোটের অংশ ছিল ৷ এর মাধ্যমে তিনি সিপিএন-ইউএমএল নেতা কেপি শর্মা ওলি-র প্রধানমন্ত্রী পদে বসার বিষয়টি আটকাতে চাইছেন ৷
গত দুই সপ্তাহ ধরে নেপালে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে ৷ এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ায় উদ্বেগ তৈরি করছে ৷ বিশেষ করে ভারতের জন্য় এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ৷
এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ, সিপিএন-ইউএমএল প্রচণ্ডর নেতৃত্বাধীন সরকার থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷ গত সপ্তাহে সোমবার মধ্যরাতে সিপিএন-ইউএমএল নেতা তথা নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি নেপালি কংগ্রেসের সভাপতি তথা নেপালের আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার সঙ্গে বৈঠক করেন ৷ সেই বৈঠকে দুই দল জোট করে সরকার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ নেপালের বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরের মেয়াদ বাকি রয়েছে ৷ এই সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ওলি ও দেউবা প্রধানমন্ত্রীর পদে বসবেন বলেও দুই দল মিলে সিদ্ধান্ত নেয় ৷
এর পর সিপিএন-ইউএমএল প্রচণ্ডকে নেপালের সংবিধানের 76(2) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পদত্যাগ করতে বলে ৷ নেপালের সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সেদেশের প্রেসিডেন্ট সংসদের এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিতে পারেন, যাঁর কাছে এক বা দুই দলের সমর্থন-সহ সংখ্য়াগরিষ্ঠতা রয়েছে ৷
কিন্তু সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টারের বৈঠকে ঠিক হয় যে প্রচণ্ড পদত্যাগ করবেন না এবং তারা হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টটিভে আস্থা ভোট চাইবে ৷ নেপালের সংবিধানের 100(2) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী যে দলের সদস্য, সেই দল যদি ভেঙে যায় কিংবা জোট সরকার থেকে কোনও শরিক সমর্থন তুলে নেন, তাহলে আস্থাভোট চাওয়া যেতে পারে ৷ এর জন্য 30 দিন সময় পাবে শাসক দল ৷ ফলে প্রচণ্ডর হাতে এক মাস সময় ছিল ৷ কিন্তু তিনি সেই সময় শেষ হওয়ার অনেক আগে আগামী 12 জুলাই আস্থাভোটের জন্য প্রস্তাব আনার দিন ঘোষণা করেছেন ৷
সর্বশেষ পরিস্থিতি নেপালের নিরন্তর পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চূড়ান্ত পরিণতি । এখানে উল্লেখ করা দরকার যে নেপালি কংগ্রেস আগে প্রচণ্ডর নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ ছিল । এই বছরের মার্চ মাসে সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টার নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সিপিএন-ইউএমএলকে জোটে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায় । এই নতুন জোটের অন্যান্য প্রাথমিক অংশীদাররা ছিল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি ও জনতা সমাজবাদী পার্টি । জনতা সমাজবাদী পার্টি চলতি বছরের মে মাসে সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টারের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে জোট থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে ।
এদিকে, প্রচণ্ড ও ওলি, দু’জনেই নতুন ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট ছিলেন বলে জানা গিয়েছে । নেপালের বর্তমান অ্যাডহক রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদী নয় বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন প্রচণ্ড ৷ তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিছু কম হয়তো করতে পারেন ৷ কিন্তু মন্ত্রীদের বারবার রদবদল চলতেই থাকবে ৷ অন্যদিকে ওলি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন বাজেট নিয়ে ৷ প্রকাশ্যেই তিনি বাজেটকে ‘মাওবাদী বাজেট’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন ।
এই সবই সিপিএন-ইউএমএল এবং সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টারের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করে ৷ সিপিএন-ইউএমএল-এর ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি প্রদীপ গাওয়ালির মতে, প্রচণ্ড একটি জাতীয় ঐক্যমত্য সরকার গঠনের জন্য গত এক মাস ধরে নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন । এটাই সিপিএন-ইউএমএল ও সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টারের মধ্যে অবিশ্বাসের একটি প্রধান কারণ হয়ে ওঠে । নেপালি কংগ্রেস যখন প্রচণ্ডর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তখন সিপিএন-ইউএমএল পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।
কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনে গাওয়ালিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, "ইউএমএল এবং কংগ্রেস কথা বলা শুরু করেছে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷" গত 29 জুন ওলি ও দেউবা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ৷ এর পর 1 জুলাই প্রচণ্ডর সঙ্গে বৈঠক করেন ওলি ৷ তার পরই ওলি ও দেউবার মধ্য়ে জোট তৈরির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় ৷
পুষ্প কুমার দহল আস্থাভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বটে, পরিস্থিতি কিন্তু তাঁর অনুকূলে নেই ৷ নেপালের হাউজ রিপ্রেজেন্টেটিভে 275 জন সদস্য ৷ নেপালি কংগ্রেস সেখানে 88 জন সদস্য নিয়ে একক বৃহত্তম দল ৷ সিপিএন-ইউএমএল এর হাতে আছে 79 জন সদস্য ৷ প্রচণ্ডর দল সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টার তৃতীয় বৃহত্তম দল ৷ তাদের সদস্য সংখ্যা 32 ৷ রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টির 21 জন ও জনতা সমাজবাদী পার্টির 5 জন সদস্য রয়েছে নেপালের সংসদে ৷
একটি প্রতিবেদন অনুসারে, প্রচণ্ড এখন কৈরালাকে অনুরোধ করেছেন নেপালি কংগ্রেসের হয়ে সরকার গড়ার জন্য ৷ কিন্তু কৈরালা সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়ে জানিয়েছেন যে এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে ৷ নেপালের রাজনীতির সঙ্গে ওয়াকিবহাল এক ব্যক্তি নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, "দহল জানেন যে ওলি প্রধানমন্ত্রী হলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তিনি (প্রচণ্ড) জেলে যাবেন ৷ তাই ওলি যাতে প্রধানমন্ত্রী না হন, সেজন্য তিনি সবকিছুই করবেন । দহল যে তাঁর সরকার মে মাসে পেশ করা বার্ষিক বাজেট সংসদে পাশ করুক ।’’
ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, ওলি অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে সুযোগ পেলে তিনি নেপালের রাজনীতি থেকে মাওবাদীদের উচ্ছেদ করবেন । 2008 সালে যখন রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে, তখন থেকেই দহলের নেতৃত্বে সিপিএন-মাওইস্ট সেন্টার নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে ৷ বিশেষ করে 2015 সাল থেকে যখন একটি নতুন সংবিধান গৃহীত হয়, সেই সময়ও তারা একই চেষ্টা করে ৷
ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, দহল অন্য দলগুলির এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের লড়াই বাঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৷ অন্যদিকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভাণ্ডারীও সিপিএন-ইউএমএল এর মধ্যে একটি উপদলের নেতৃত্ব দেন, যারা চায় চীন-পন্থী বাম ঐক্য জোট সরকার ক্ষমতায় থাকুক । সেটা হলে, তা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে হবে ৷
এই কারণেই এটা ভারতের জন্য ভালো হবে, যদি নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন-ইউএমএল-এর সমন্বয়ে একটি জোট সরকার গঠিত হয় এবং ওলি ও দেউবা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী হন ৷