কলকাতা, 12 সেপ্টেম্বর: বাম নেতা-কর্মীরা এক বিশেষ সমালোচনার মুখে পড়েন । তা হল, তাঁরা বড় বেশি তত্ত্বের কথা বলেন । সেখানে নাকি মানুষের কথা হারিয়ে যায় ! ভারতের মতো বহু ভাষা, বহু জাতি আর বহু ধর্মের দেশে এই প্রশ্ন উঠবে তাতে আর আশ্চর্য কী! এক শতাব্দীর বাম আন্দোলনে যাঁরা যাঁরা এই ধারনা ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সীতারাম ইয়েচুরির নাম উপর দিকেই রাখতে হবে । বইয়ের মলাট আর ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভাষায় সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন জেএনইউ-র এই প্রাক্তন ছাত্র সভাপতি । তাঁর প্রয়াণ সেদিকও থেকে বামপন্থী আন্দোলনের কাছে ধাক্কা ।
সীতারামের রাজনৈতিক জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকেই শুরু তাঁর রাজনৈতিক জীবন । রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশ মনে করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বামেদের মৃগয়াভূমি হিসেবে গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন সীতারাম । এখানে তাঁর অগ্রজ আরও এক প্রবীণ নেতার নাম বলতই হয় । তিনি প্রকাশ কারাত। সিপিএমের এই প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন জেএনইউয়ের ছাত্র সভাপতি ।
1975 সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয় । সে সময় জেএনইউ-র ছাত্র সভাপতি ছিলেন সীতারাম। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি । তাঁর সামনে ছাত্রদের বক্তব্য পড়ে শোনান সীতারাম । পরে বিশ্ববিদ্যালের আচার্য পদ ছেডে দেন ইন্দিরা । ভারতের সাত দশকের সংসদীয় ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেছে বলে মনে করতে পারছেন না রাজনৈতিক মহল ।
বাংলার বাম রাজনীতি সীতারামকে ছাড়া অসম্পূর্ণ বললে হয়তো খুব ভুল বলা হবে না । বাংলা থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন একাধিকবার । সেটা এই সম্পর্কের ভিত্তি হলেও সবটা নয় । অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে সিপিএম তৈরি হওয়ার পর থেকে দলের ভিতরে দুটি গোষ্ঠীর কথা শোনা যেতে থাকে । সংবাদমাধ্যম এদের বাংলা ও কেরল লবি বলে অভিহিত করে এসেছে ।
এই দুটি রাজ্যে বামেদের সরকার সবচেয়ে বেশি সময় ধরে থেকেছে । এখনও শুধু কেরলেই সরকার চালায় বামেরা । সেদিক থেকে, 'এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়...' খুব অস্বাভাবিক কিছু নয় । তবে এই দুই তথাকথিত লবির সংঘাতের মূল জায়গা হচ্ছে একটি আদর্শগত বিবাদ । কেরল লবি দলকে তাত্বিক দিক থেকে মজবুত করার পক্ষে সওয়াল করে এসেছে । আর বাংলা লবির লক্ষ্য থেকেছে, পার্টিকে জনতার মধ্যে স্থান করে দেওয়া ।
এই বিবাদ থেকে খুব স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্ন আসে তা হল সরকারে যাওয়া উচিত কি উচিত নয় । বামেদের সাধারণ অবস্থান যে সরকারের তারা নিয়ন্ত্রক নয় সেখানে তারা অংশ নেবে না । অবস্থান বদলানো দরকার কিনা সেই প্রশ্ন সবথেকে বড় আকারে দেখা দিয়েছিল 1996 সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর । বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় সেবার । সেই যুক্তি থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার শপথ নেয় । 13 দিনের মধ্যে সরকার টিকিয়ে রাখার যাদুসংখ্যা জোগাড় করতে না পারায় পদত্যাগ করেন বাজপেয়ী ।
সেবার যা অবস্থা দাঁড়ায় তাতে কংগ্রেস বা বিজেপির কেউ নন, অন্য দলের কাউকে প্রধানমন্ত্রী হতে হত । এই দৌড়ে সবচেয়ে আগে ছিলেন জ্যোতি বসু । বাংলার দু'দশকের (1996 সাল পর্যন্ত) মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল সর্বজনবিদিত । তিনি নিজেও রাজি ছিলেন । আম বাঙালির আশা ছিল এবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাসিন্দা হবেন কোনও বঙ্গসন্তান । শেষমেশ তা হয়নি । তার কারণ কেরল লবি । প্রকাশ কারাতরা বাধা দেন । শুধু কেরল লবি নয় বাংলার বেশ কয়েকজন বামনেতাকেও পাশে পাননি জ্যোতি বসু । পরে দলের এই অবস্থানকে তাঁর 'ঐতিহসিক ভুল' বলে মনে হয়েছিল । সে সময়ও কিন্তু সীতারামের সমর্থন ছিল জ্যোতি বসুর পক্ষে ।
এর অনেক বছর বাদে কংগ্রেসের হাত ধরা নিয়েও দলের অনেকের বিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে সীতারামকে । কেরলে সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস । সেখানে পশ্চিমবঙ্গে জোট করলে তার প্রভাব কেরলে পড়তে পারে বলে সিপিএমের অনেকেই এ রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোটের বিপক্ষে ছিলেন । কিন্তু সীতারাম সেই রাস্তায় হাঁটেননি । বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসের হাত ধরতে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি। বলা যেতেই পারে বিজেপিকে রুখতে সীতারামদের নেওয়া এই অবস্থান পরবর্তীকালে ইন্ডিয়া শিবিরকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল ।
রাজনীতির ক্ষেত্রে বারবার এমন চরিত্র এসেছেন যাঁরা নিজেদের দলীয় রাজনীতির উর্ধে নিয়ে যেতে পেরেছেন । সেই তালিকাতেও সীতারাম আছেন একেবারে উপরে। কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিজেপি সকলের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক রক্ষা করেছেন তিনি । এমনকী বামনেতার মধ্যে সীতরামের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি থেকেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। এবার সেই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা শেষ হল । 72 বছর বয়সে অচেনা-অজানার দেশে পাড়ি দিলেন সকলের 'প্রিয় কমরেড' সীতারাম ইয়েচুরি ।