ঝাড়গ্রাম, 12 এপ্রিল: মতুয়া, রাজবংশীর পর এবার কুড়মি ৷ দীর্ঘ দিন ধরে তফশিলি উপজাতিভুক্ত হওয়ার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে কুড়মিরা ৷ তবে রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার, কেউই তাদের দাবি পূরণ করতে পারেনি ৷ তাই এবার সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিল কুড়মিরা ৷ অর্থাৎ 2024 সালের নির্বাচনে দিল্লিতে জনপ্রতিনিধি পাঠাতে চায় তারা ৷ আসন্ন নির্বাচনে তাদের স্লোগান 'আমাদের ভোট আমাদেরই থাক' ৷ পঞ্চায়েতের পর এই স্লোগানকে সামনে রেখেই ফের ভোট-ময়দানে কুড়মী সমাজ ৷
প্রধানত ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে কুড়মিদের বাস ৷ ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে কুড়মি ভোটের হার 24-26 শতাংশ ৷ এর মধ্যে বান্দোয়ান বিধানসভা কেন্দ্রে 40 শতাংশের বেশি কুড়মি ভোটার ৷ অন্যদিকে গড়বেতা বিধানসভায় 5 শতাংশের নীচে ৷ অন্যদিকে পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে 7টি কেন্দ্র 37.37 শতাংশ কুড়মি ভোটার রয়েছে ৷ এর মধ্যে বাগমুণ্ডি বিধানসভায় 50 শতাংশ এবং পাড়া বিধানসভায় মাত্র 18 শতাংশ কুড়মি ভোটার ৷
এই হিসেব নিয়েই ঝাড়গ্রাম সংরক্ষিত আসনে দু'টি সামাজিক সংগঠন পৃথকভাবে কুড়মি প্রার্থী দিয়েছে ৷ আদিবাসী নাগাচারি কুড়মি সমাজ বরুণ মাহাতোকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে ৷ তিনি নদিয়া জেলার বাসিন্দা এবং তাঁর এসটি শংসাপত্র আছে ৷ অন্যদিকে অজিতপ্রসাদ মাহাতোর নেতৃত্বাধীন আদিবাসী কুড়মি সমাজ সূর্যসিং বেশরাকে প্রার্থী করেছে ৷ তিনি ঝাড়খণ্ড পিপলস পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ৷ ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলার প্রাক্তন বিধায়ক ৷
তাদের তফশিলি উপজাতি করার দাবিতে কুড়মিরা কখনও রেল, তো কখনও জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছে ৷ বনধ কর্মসূচি নিয়েছে ৷ অজিতপ্রসাদ মাহাতোর নেতৃত্বাধীন আদিবাসী কুড়মি সমাজ, শিবাজী মাহাতোর নেতৃত্বাধীন আদিবাসী জনজাতি কুড়মি সমাজ, রাজেশ মাহাতোর নেতৃত্বাধীন কুড়মী সমাজ পশ্চিমবঙ্গ, অনুপ মাহাতোর নেতৃত্বাধীন আদিবাসী নাগাচারি কুড়মি সমাজ এই দাবিতে পৃথক পৃথক কর্মসূচির মাধ্যমে এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ৷
তবে কোনও সমাধান না পেয়ে এবার নিজেদের ভোট নিজেদের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কুড়মিরা ৷ আর তা বাস্তবায়নে দিল্লিতে প্রতিনিধি পাঠাতে চায় তারা ৷ তাই দু-দু'জন কুড়মি প্রার্থী এই ভোটে লড়বেন ৷ 2019 সালের ভোটে তৃণমূল-বিরোধী আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল ৷ সেবার ঝাড়গ্রামে বিজেপি জয়ী হয়েছিল ৷ মোট ভোটের 44.56 শতাংশ পেয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন কুনার হেমব্রম ৷ দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তৃণমূলের বীরবাহা সোরেন ৷ তিনি 43.72 শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন ৷ এবারে এই কেন্দ্রে দু'দু'জন কুড়মি প্রার্থী হওয়ায় স্বভাবতই কুড়মি ভোট ভাগ হবে ৷ আর তার অনেকটাই কুড়মি প্রার্থীদের কাছেই যাবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ ৷
এই ভোট ভাগে সুবিধে কোন দলের ? এই উত্তরের কিছুটা পূর্বাভাস লুকিয়ে আছে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলের মধ্যে ৷ 2023 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে জুন মাসে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ার কর্মসূচি ছিল ঝাড়গ্রামে ৷ সেখানে গড়শালবনি এলাকায় অভিষেকের কনভয়ের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে কুড়মিদের বিরুদ্ধে ৷ এই ঘটনায় কুড়মি সমাজের হেভিওয়েট নেতাদের গ্রেফতার করা হয় ৷ এর প্রতিবাদে পঞ্চায়েত নির্বাচনের লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় কুড়মিরা ৷ এমনকী নিজেদের দেওয়ালে কোনও রাজনৈতিক দলকেই তারা দেওয়াল লিখন করতে দেয়নি ৷ দলীয় ঝান্ডা বাঁধতে দেয়নি ৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, 138টি গ্রামপঞ্চায়েতের নির্দল প্রার্থী জয়ী হয়েছে ৷ তাঁদের বেশিরভাগই ছিল কুড়মি ৷ এদিকে 2018 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি খুব ভালো ফল করলেও এবার তারা জয়ী হয় মাত্র 131টি আসনে ৷ তাই বোঝাই যাচ্ছে, কুড়মি প্রার্থীরা দাঁড়ানোয় কোন দলের উপর প্রভাব পড়েছে ৷
এদিকে 2018 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল যে পঞ্চায়েতগুলি হারিয়েছিল, সেগুলিও ফিরে পায় তৃণমূল ৷ ঝাড়গ্রাম জেলা পরিষদ, ঝাড়গ্রামের 8টি পঞ্চায়েত সমিতির একচেটিয়া দখল নেয় তৃণমূল । 79টি গ্রামপঞ্চায়েত অঞ্চলের মধ্যে সিংহভাগই যায় ঘাসফুলের দখলে ৷ বিজেপির দখলে থাকা একাধিক গ্রামপঞ্চায়েত ও দু'টি পঞ্চায়েত সমিতি হাতছাড়া হয়ে যায় ৷ হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েতের দখল পায় বিজেপি ৷ তৃণমূলের ভালো ফলাফল ও বিজেপির খারাপ ফলাফলের কারণ হিসেব কুড়মিদের ভোটে লড়ার বিষয়টিকেই বিশেষ গুরুত্ব দেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ৷
এই ফলাফলের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, কুড়মিরা লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ায় ঝাড়গ্রামে ভালো ফল করবে তৃণমূল ৷ 2019 সালে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রটি পেয়েছিল বিজেপি ৷ কুড়মিদের 'আমাদের ভোট আমাদেরই থাক' কৌশলের জন্যে 2024 সালে এই আসনটি তৃণমূলের দখলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ৷ অন্যদিকে, আদিবাসী নাগাচারী কুড়মি সমাজের রাজ্য সভাপতি অনুপ মাহাতোর দাবি, রাজ্য ও কেন্দ্র- কোনও সরকারই তাদের কথা ভাবছে না ৷ তাই গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী তারা তাদের ভোট অন্য কোনও দলের কাছে যেতে দেবে না ৷
অনুপ মাহাতোর কথায়, "আমরা আন্দোলন করেছি ৷ এবার জঙ্গলমহল তথা ছোটনাগপুরের এই অঞ্চলে লোকসভা নির্বাচনে ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে এই আন্দোলনটা করছি ৷" তাঁর দাবি, "গড়বেতা বাদ দিয়ে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের বাকি এলাকাগুলি কুড়মি-বহুল ৷ কোনও কোনও বিধানসভায় 35 শতাংশ কুড়মি বাস করে ৷ এই কুড়মি ভোটের সঙ্গে এসসি, এসটি, ওবিসি, মাইনরিটি ভোটগুলি যদি আমরা সংগ্রহ করতে পারি, অর্থাৎ যারা আমাদের সঙ্গে সহাবস্থান করে, তাদের ভোটগুলি পেলে ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলে একটা ইতিহাস তৈরি হবে ৷" অনুপ মাহাতো আত্মবিশ্বাসী, "আমাদের প্রার্থীকে এখানকার বহু জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ সমর্থন জানিয়েছে ৷ আমাদের প্রার্থী জয়লাভ করবে ৷"
কী বলছে বিজেপি ? ঝাড়গ্রাম জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি দেবাশিস কুণ্ডু বলেন, "পঞ্চায়েত নির্বাচনে কুড়মিরা প্রার্থী দিয়েছিল ৷ কিন্তু তারা সেভাবে আসন পায়নি ৷ লোকসভা নির্বাচনে তারা প্রার্থী দিয়ে যে বিশাল কিছু ভোট ভাগ করতে পারবে, সেটাও আশা করি না ৷"
ঝাড়গ্রামে সিপিএমের বক্তব্য- বাম নেতৃত্ব অবশ্য মেনে নিয়েছে যে, কুড়মিরা ভোটে দাঁড়ালে ভোট বাক্সে তার প্রভাব পড়বে ৷ ঝাড়গ্রাম জেলা সিপিএমের জেলা সম্পাদক প্রদীপ কুমার সরকার বলেন, "গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচনে কুড়মিদের ভোট ব্যাঙ্কে প্রভাব পড়ছে না, এটা বলব না ৷ আমরা কুড়মিদের আন্দোলনকে সমর্থন করি ৷ কারণ তারা তাদের জাতিসত্তার দাবিতে যেভাবে দিনের পর দিন রাস্তায় বসে আন্দোলন করছে, লড়াই করছে, তাতে কুড়মিদের আবেগকে দাবিয়ে রাখা যায় না ৷" তবে এর পাশাপাশি তিনি এও মনে করিয়ে দিয়েছেন, "এমন কোনও পদক্ষেপ করা উচিত নয় যাতে, এই ভোট প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রে বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূল সরকার কোনও সুবিধে পেয়ে যায় ৷"
ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি প্রসূন সড়ঙ্গির দাবি, "কুড়মিরা তৃণমূলের সমর্থক ৷ তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের উন্নয়নে বিশ্বাসী ৷" গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে কুড়মিদের ভোটে লড়ার ফলে বেনিফিট পেয়েছিল তৃণমূল ৷ এবারও কি সেই বেনিফিট ঘরে তুলতে পারবে ঘাসফুল ? নাকি অনুপ মাহাতোদের দিল্লিতে প্রতিনিধি পাঠানোর স্বপ্ন পূরণ হবে ? ঝাড়গ্রামে কুড়মী প্রার্থীদের ভোটযুদ্ধ তৃণমূলের কালীপদ সোরেন, বিজেপির ড. প্রণত টুডুর বিরুদ্ধে ৷ মতুয়া, রাজবংশীদের মতো কুড়মিরাও কি জনপ্রতিনিধি পাঠাতে পারবে ? উত্তর জানতে অপেক্ষা 4 জুন পর্যন্ত ৷
আরও পড়ুন: