কলকাতা, 12 নভেম্বর: রাজ্যের ছ'টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন বুধবার ৷ কোচবিহারের সিতাই, আলিপুরদুয়ারে মাদারিহাট বিধানসভা, বাঁকুড়ার তালডাংরা, মেদিনীপুর বিধানসভা, উত্তর 24 পরগনার নৈহাটি এবং হাড়োয়া বিধানসভা ৷ এর মাদারিহাট ছাড়া বাকি 5টি আসনই তৃণমূলের দখলে ৷ আলিপুরদুয়ার লোকসভার মাদারিহাট আসনের বিধায়ক বিজেপির ৷ ফলাফল জানা যাবে 23 নভেম্বর ৷
এই কেন্দ্রগুলির বিধায়করা 2024 সালের লোকসভা ভোটে জিতে সংসদের নিম্নকক্ষে নির্বাচিত হওয়ায় আসনগুলি ফাঁকা হয়ে যায় ৷ একইসঙ্গে হাড়োয়ার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলাম লোকসভা নির্বাচনে জেতার কয়েক মাস বাদে প্রয়াত হন ৷
সিতাই বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক জগদীশ চন্দ্র বর্মা বাসুনিয়া এবার কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়েন এবং জয়ী হন ৷ তাই বিধানসভা আসনটি খালি হয়ে যায় ৷ মাদারিহাট বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন বিজেপির মনোজ টিগ্গা ৷ তিনি আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন ৷ মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ জুন মালিয়া মেদিনীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন ৷ তিনি সাংসদ হওয়ার পর আসনটি এখন ফাঁকা ৷
বাঁকুড়া জেলার বাঁকুড়া লোকসভার অন্তর্গত তালডাংরা বিধানসভা ৷ 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে 46 শতাংশ ভোট পেয়ে এই তালডাংরা আসনে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তী ৷ 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনিই বাঁকুড়া লোকসভা থেকে প্রার্থী হন এবং সেখান থেকেও জেতেন ৷ স্বভাবত তালডাংরা আসনটি জনপ্রতিনিধি শূন্য হয়ে যায় ৷ ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে নৈহাটি বিধানসভা আসনে বিধায়ক ছিলেন তৃণমূলের পার্থ ভৌমিক ৷ ছিলেন রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য । তিনি ওই লোকসভা কেন্দ্র থেকেই বিজেপির প্রভাবশালীন নেতা অর্জুন সিংহকে হারিয়ে নির্বাচিত হন ৷ ফলে ফাঁকা হয়ে যায় নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্র ৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বেশির ভাগই মনে করেন, ভোটের রাজনীতিতে উপ-নির্বাচনে গুরুত্ব তেমন একটা কিছু নয় ৷ মোটামুটি হিসেবটা জানা থাকে ৷ এছাড়া উপ-নির্বাচন দিয়ে তো আর সরকার ভাঙা-গড়া হয় না ৷ বাংলার ক্ষেত্রে উপনির্বাচনের এই তত্ত্ব খাটে না ৷
এটা সত্যি, ছ'টি উপ-নির্বাচন দিয়ে সরকার বদল হবে না ৷ কিন্তু এর প্রভাব বহুদূর বিস্তৃত ৷ তাছাড়া এর ফলাফল থেকে পরবর্তী নির্বাচনের একটা আভাস পাওয়া যাবে ৷ ভোটাররা কোনদিকে ঝুঁকছে, তা কিছুটা বোঝা যায় ৷ বিশেষত অগস্টে আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার রুমে তরুণী পড়ুয়া চিকিৎসকের মৃত্যুর পর বাংলার ভোটাররা কী চাইছেন ? তার একটা প্রতিফলন এই উপ-নির্বাচনে পড়বে বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ ৷
2011 সালের আগে 2009-এর উপনির্বাচনের ফলাফলে রাজ্যের রাজনীতির একটা বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছিল ৷ সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের বিক্ষোভ, আন্দোলনকে হাতিয়ার করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ উত্তরবঙ্গে রায়গঞ্জ, দক্ষিণ 24 পরগনার বিষ্ণুপুর-পশ্চিম বিধানসভা (এখন অঞ্চল পুনর্বিন্যাসের ফলে আসনটির অস্তিত্ব নেই) এবং কলকাতার বেলগাছিয়া-পূর্বে (এখন অঞ্চল পুনর্বিন্যাসের ফলে আসনটির অস্তিত্ব নেই) উপ-নির্বাচন হয়েছিল 2009 সালে ৷
সেবার বাংলার মসনদ লালই ছিল ৷ কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস জোটের কাছে বড় ধাক্কা খেয়েছিল সিপিএম ৷ রায়গঞ্জ জয়ী হয়ে কার্যত ইতিহাস গড়েছিলেন খগেশ্বর রায় ৷ উত্তরবঙ্গে তিনিই প্রথম ঘাসফুল ফুটিয়েছিলেন ৷ বিষ্ণুপুর-পশ্চিম বিধানসভা থেকে নিজেদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয় কংগ্রেস ৷ সিপিএম-এর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তৃণমূলের মদন মিত্র এবং তিনিও জয়ী হন ৷
বেলগাছিয়া-পূর্বে পরিস্থিতিটা অন্যরকম ছিল ৷ সিপিএমের জনপ্রিয় নেতা সুভাষ চক্রবর্তী এই কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন ৷ তাঁর মৃত্যুতে আসনটি ফাঁকা হয়ে যায় ৷ তাঁর স্ত্রীকে প্রার্থী করেছিল সিপিএম ৷ সুভাষ চক্রবর্তীর একসময়ের অনুগত ও ঘনিষ্ঠ সুজিত বসুকে এই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করে একেবারে চমকে দিয়েছিলেন মমতা ৷ তৃণমূলের সুজিত বসু, সুভাষ-পত্নী রমলাকে হারিয়ে নেত্রীর হিসেব মিলিয়ে দেন ৷
এধরনের উথালপাথাল করা ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে মাঝেমধ্য়ে ঘটে থাকে, যেখানে উপ-নির্বাচনগুলিতে বিরোধীরা জয়ী হয় ৷ 2019 সালে লোকসভা নির্বাচনের পাশাপাশি বিধানসভা উপ-নির্বাচন হয়েছিল ৷ সেবার উত্তর 24 পরগনার ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের মদন মিত্রের প্রতিপক্ষ ছিলেন বিজেপি নেতা অর্জুন সিংয়ের ছেলে পবন সিং ৷ মদন মিত্রকে হারিয়ে দিয়েছিলেন গেরুয়া শিবিরের পবন ৷
ছ'টি বিধানসভা উপ-নির্বাচনে কোথায় কারা প্রার্থী ?
এবারের উপ-নির্বাচনে অন্যতম বিশেষত্ব বাম ও কংগ্রেস জোট বাঁধেনি ৷ একাই লড়ছে সিপিআই(এম), সিপিআই ও কংগ্রেস ৷ বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন ৷
আগামিকাল যে ছ'টি বিধানসভা আসনে উপ-নির্বাচন, তার মধ্যে পাঁচটিই একুশের বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছিল তৃণমূল ৷ শুধু মাদারিহাটের দখল নিয়েছিল বিজেপি ৷ এই আসনটিতে তৃণমূলের লড়াই সম্মান রক্ষার ৷ কারণ মাদারিহাটে তৃণমূল কোনও বারই জয়ী হয়নি ৷ এমনকী 2011 সালের বিধানসভা উপনির্বাচনে রাজ্যে ঘাস-ফুল ঝড় ওঠে, সেই সময়েও নয় ৷ 2016 পর্যন্ত এই কেন্দ্রটি বামফ্রন্টের দখলে ছিল ৷ তারপর থেকে বামের আসন গিয়েছে রামের কাছে ৷ 2019 এবং 2024-এর লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি এই লোকসভায় জয়ী হয়েছে ৷
এবার মাদারিহাটে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী জয়প্রকাশ টোপ্পো ৷ তিনি তৃণমূলের ব্লক সভাপতি ৷ তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী রাহুল লোহার ৷ তিনিও বিজেপির মণ্ডল সভাপতি ৷ বাঁকুড়ার তালডাংরা বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী ফাল্গুনী সিংহবাবু ৷ তিনি পেশায় সারেঙ্গার গড়গড়্যা সুভাষ হাইস্কুলের শিক্ষক এবং সিমলাপাল ব্লক তৃণমূলের সভাপতি । তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী অনন্যা রায় চক্রবর্তী ৷ তিনি একসময় তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন ৷ একুশের নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে লড়ে জয়ী হন ৷ পরে বিজেপিতে যোগ দেন ৷
কোচবিহারের সিতাই বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী সঙ্গীতা রায় ৷ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের হরিহর রায় সিংহ ৷ তৃণমূল প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করার আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী হরিহর রায় সিংহ । গতকাল সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আদালত ৷ এছাড়া বিজেপির প্রার্থী দীপক কুমার রায় ৷
মেদিনীপুর বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী পরিচিত মুখ, জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা ৷ এই কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী মণিকুন্তল খামরুই, কংগ্রেসের শ্যামল কুমার ঘোষ, বিজেপির শুভজিৎ রায় ৷ উত্তর 24 পরগার নৈহাটি বিধানসভা থেকে সাংসদ হয়েছেন পার্থ ভৌমিক ৷ এই কেন্দ্রে তাঁর ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা সনৎ দে'কেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল ৷ তাঁর প্রতিপক্ষ বিজেপির রূপক মিত্র, কংগ্রেসের পরেশ নাথ সরকার এবং সিপিআই(এম-এল)এল-এর দেবজ্যোতি মজুমদার ৷ উত্তর 24 পরগনারই হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন ৷ এখানে তৃণমূল প্রার্থী শেখ রবিউল ৷ তাঁর বিরুদ্ধে আইএসএফ পিয়ারুল ইসলাম, বিজেপির বিমল দাস, কংগ্রেসের হাবিব রেজা চৌধুরী ৷
আরজি কর-পরবর্তী এই ছ'টি বিধানসভা উপনির্বাচনে জুনিয়র চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুন, জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের প্রভাব পড়ল কি ? শাসকদল তৃণমূলকে কোথাও অস্বস্তিতে ফেলেনি তো হাসপাতালগুলির থ্রেট কালচার ৷ নৈহাটি কেন্দ্রে সিপিআই(এম) এবং সিপিআই(এমএল)-এর সমঝোতা কোনও প্রভাব ফেলবে কি ? লোকসভা নির্বাচনে খারাপ ফল করেছে বিজেপি ৷ উপ-নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের তকমা টিকিয়ে রাখতে পারবে তো গেরুয়া শিবির ? এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে 23 নভেম্বর ৷