মালদা, 15 অগস্ট: ভাঙন ছিলই, দোসর হল বন্যা ৷ গঙ্গার সাঁড়াশি চাপে নাজেহাল দশা মানিকচক ব্লকের হাজার 70 মানুষের ৷ বাঁধ ভাঙা জলে বিপন্নর সংখ্যাটি পৌঁছে যেতে পারে লাখ দেড়েকে ৷ কারণ, যেভাবে গঙ্গার জল ভূতনি চরের সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকতে শুরু করেছে, তাতে সেখানে থাকা তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতই বানভাসি হওয়ার সম্ভাবনা ৷
আশার কথা, মঙ্গলবার সকাল থেকে গঙ্গার জলস্তর স্থিতিশীল হয়েছে ৷ নতুন করে আর জল বাড়েনি ৷ তবে ফের যে কোনও সময় জলস্তর বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে ৷ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই ময়দানে নেমে পড়েছে জেলা প্রশাসন ৷ নদীর জলস্তর বিপদসীমার উপরে থাকলেও বিশেষ পদ্ধতিতে ভাঙা বাঁধ মেরামতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা সেচ দফতর ৷ প্রশ্ন উঠেছে, কেন বারবার একই জায়গায় আঘাত হানছে গঙ্গা ? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ইটিভি ভারত ৷
গঙ্গা আর ফুলহর নদী দিয়ে চারদিক ঘেরা ভূতনি চর ৷ অসমের মাজুলির পর বৃহত্তম নদী ব-দ্বীপ হিসাবে ভূতনির অবস্থান ৷ চরে 63টি গ্রাম রয়েছে ৷ রয়েছে তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত ৷ লাখ দেড়েক মানুষের বসবাস ৷ 2019 সালের আগে পর্যন্ত চরে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল একমাত্র নৌকা ৷ চরে যাতায়াতের সুবিধের জন্য সেবছর 1.8 কিলোমিটার লম্বা একটি ব্রিজ চালু করে রাজ্য সরকার ৷ চরে মূলত কৃষি নির্ভর মানুষের বসবাস ৷ কিছু চরবাসী গবাদি পশু প্রতিপালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন ৷ চরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কয়েক বছর আগে ভূতনি থানা গঠিত হয়েছে ৷
প্রায় প্রতি বছরই গঙ্গার রোষে পড়ে এই চর ৷ চলে ভাঙন ৷ ভাঙনের কোপে পড়ে নদীবাঁধ ৷ এভাবে গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে সাতটি রিং বাঁধ ৷ স্রোতের টানে খাসমহল ও কেশরপুর কলোনিতে বাঁধের দু'টি অংশ গত পরশু কেটে গিয়েছে ৷ গঙ্গাজল ঢুকে পড়েছে উত্তর চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ সংরক্ষিত অংশে ৷ বিপন্ন মানুষজন উঁচু জায়গার সন্ধানে ৷ বেশ কিছু পরিবার কাটা বাঁধের উপরেই প্লাস্টিক টাঙিয়ে বসবাস শুরু করেছে ৷ কিন্তু যে গতিতে জল সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকছে, তাতে চরের বাকি দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত, দক্ষিণ চণ্ডীপুর ও হীরানন্দপুরও নিশ্চিতভাবে বানভাসি হতে চলেছে বলে মনে করছেন চরবাসীরা ৷ তাঁদের মতে, পুরো ভূতনি চর বানভাসি হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ৷
এক চরবাসী আবু কালাম জানাচ্ছেন, "গত পরশু মাঝরাতে জলের টানে বাঁধ ভেসে গিয়েছে ৷ হু হু করে গঙ্গার জল ঢুকে পড়ছে ৷ এভাবে জল ঢুকতে থাকলে তিনটি পঞ্চায়েত এলাকাই প্লাবিত হবে ৷ এবার দু'জায়গায় বাঁধ কেটেছে ৷ এই পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে কেউ জানে না ৷ নদীর জল কমে গেলেও চরে ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি থেকে জল নামতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে ৷"
চরের আরেক বাসিন্দা দীনেশ ঘোষ জানান, "প্রায় প্রতি বছরই অল্পবিস্তর নদীর জল সংরক্ষিত এলাকায় ঢোকে ৷ চরে সবচেয়ে বেশি জল হয়েছিল 1998 সালে ৷ সেবার আমি বন্যায় ডুবে গিয়েছিলাম ৷ এবার নদীর যা মতিগতি তাতে আমাদের ধারণা, এবারও 1998 সালের মতো বন্যা হবে ৷ আমাদের এই দুর্দশার মধ্যে থাকতে হলেও বাঁধ সংস্কারের জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না ৷ গতবার বাঁধের কিছুটা অংশ বাঁধা হয়েছিল ৷ আমরাও একটু শান্তি পেয়েছিলাম ৷ এবার কেউ আসছে না ৷ এবার যদি গোটা চর ভেসে যায়, তবে মানুষ কোথায় যাবে ? বাঁধের উপরেও তো জায়গা নেই ৷ পরিস্থিতি দেখতে এখনও প্রশাসনের কেউ আসেনি ৷"
চরের কালুটোনটোলায় বাড়ি বিমল মাহাতোর ৷ এখন তাঁর ঘরে বুকজল ৷ সাপ-সহ বিষাক্ত পোকামাকড় জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ তাই আর বাড়িতে থাকার সাহস দেখাননি ৷ পরিবার নিয়ে উঠে এসেছেন বাঁধে ৷ তিনি বলছেন, "বাড়ির পরিস্থিতি খুব খারাপ ৷ কোথাও কোমর, কোথাও বা বুকজল ৷ আর ঘরে থাকা যাবে না ৷ ব্লক অফিস থেকে একটা ত্রিপল পেয়েছি ৷ এখনও খাবার পাইনি ৷ বাঁধে পানীয় জলেরও ব্যবস্থা নেই ৷ নদীর জলই খেতে হচ্ছে ৷ কিছু করার নেই ৷ এখনও প্রশাসনের কেউ আসেনি ৷ এখানে বারবার রিং বাঁধ করা হচ্ছে ৷ কিন্তু কেটে যাচ্ছে ৷ টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না ৷ তাই ফি বছর আমাদের এই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে ৷ জমি জায়গা সব নদীতে কেটে গিয়েছে ৷ প্রশাসনের কাছে আমার আর্জি, এখানে গঙ্গার পাড়টা একটু ভালো করে বেঁধে দেওয়া হোক ৷"
পরিস্থিতি মোকাবিলায় অবশ্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে প্রশাসন ৷ ইতিমধ্যে মানিকচক ব্লক অফিসে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম ৷ খোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্লাড শেল্টার ৷ প্রয়োজনে আরও শেল্টার খোলা হবে বলে জানিয়েছে মানিকচক ব্লক প্রশাসন ৷ বাঁধে মোতায়েন করা হয়েছে এনডিআরএফ টিম ৷ রয়েছেন গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীরাও ৷ প্রসূতি কিংবা শিশুদের কোনও সমস্যা হলে দ্রুত পদক্ষেপ করবেন তাঁরা ৷
উত্তর চণ্ডিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অর্চনা মণ্ডল বলেন, "11 তারিখ রাতে কেশরপুর কলোনিতে গঙ্গার বাঁধ কেটে যায় ৷ গঙ্গার জল কেশরপুর কলোনি হয়ে ভুবনটোলা, মানিকনগর, দুর্লভটোলা, গঙ্গাধরটোলা, কাঞ্চনটোলা, পরাণটোলা, অশোকনগর কলোনি, কৃষ্ণটোলা, রাহাতপুর, চম্পানগর-সহ একাধিক গ্রাম ভাসিয়ে দিয়েছে ৷ নদীর জল পুরো ভূতনিতে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে ৷ এখনও পর্যন্ত 60-70 হাজার মানুষ বানভাসি কিংবা জলবন্দি হয়ে পড়েছেন ৷ আমরা দুর্গতদের যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করছি ৷"
তাঁর নিজের বাড়িতেও ঢুকে পড়েছে গঙ্গার জল ৷ তবু বানভাসি হওয়া প্রসূতি ও শিশুদের দিকে তাকিয়ে বাঁধে ডিউটি করে যাচ্ছেন মৌসম কুমারী ৷ তিনি বলেন, "গতকাল থেকে আমরা বাঁধে ডিউটি করছি ৷ ওষুধপত্র আমাদের সঙ্গে রয়েছে ৷ কারও কোনও সমস্যা হলে আমরা এখান থেকেই ওষুধপত্র দিতে পারব ৷ আমরা এখন গ্রামের ভিতরে ঢুকতে পারছি না ৷ নৌকাভাড়া 500 টাকা চাইছে ৷ এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের তরফে আমাদের নৌকার ব্যবস্থা করা হয়নি ৷ শুনছি, আমাদের একটা নৌকা দেওয়া হবে ৷ আমার বাড়িতেও জল ৷ কিন্তু মানুষের স্বার্থ দেখতেই হবে ৷ আমার এলাকায় চারজন প্রসূতি রয়েছেন ৷ তাঁদের উপর নজর রাখা হচ্ছে ৷"
ভূতনি থানার পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গঙ্গার জলে বানভাসি মানিকনগরে এক ছাত্র জলের স্রোতে ভেসে গিয়েছে ৷ তার নাম এন্তাজুল আলি ৷ বন্যার জলে খেলতে গিয়ে সে ডুবে যায় ৷ তাকে বাঁচানো যায়নি ৷ কিন্তু কেন বারবার একই জায়গায় গঙ্গা ধাক্কা মারছে ? গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিষয়ের অধ্যাপক অরিজিত দাস বলছেন, "রাজমহল থেকে মালদায় প্রবেশের মুখেই ভূতনি চর ৷ গঙ্গা, কোশি আর পূনর্ভবার মিলিত প্রবাহ সেখান দিয়ে প্রবাহিত হয় ৷ ভূতাত্বিকভাবে ভূতনি চর ভীষণ অস্থির প্রকৃতির ৷ চরটি আদপে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতো ৷ রাজমহল থেকে মালদায় ঢোকার পর গঙ্গার খাত হঠাৎ কমে যাওয়ায় বহন ক্ষমতা অনেকটা হারিয়ে যায় ৷ তাতেই নদীর পলি, নুড়ি দিয়ে এই চর তৈরি হয়েছে৷ ওই চরে এখনও অনেক ছোট ছোট অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতো জলাভূমি রয়েছে ৷"
তাঁর কথায়, "বর্ষায় নদীর বিপুল জলরাশি ওই সমস্ত হ্রদের আকৃতির পথ দিয়ে বয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ৷ ওই চরের মাটি বালি দিয়ে তৈরি ৷ ফলে যতই বাঁধ দেওয়া হোক না কেন, বিপুল জলরাশির স্রোত আটকাতে পারে না ৷ তার উপর গঙ্গা তার গতিপথ বদল করছে ৷ এর ফলেই প্রতি বছর এখানে ভাঙন ও বন্যা হয় ৷ ভাঙন আটকাতে ড্রেজিং-এর কথা বলা হলেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে তার বিপুল খরচ বহন করা কতটা স্বাভাবিক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ৷ তবে নমামি গঙ্গে প্রকল্পে এখানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কাজ হলে এই সমস্যা অনেকটা মেটানো যেত ৷ কোনও এক অজানা কারণে অসমের মাজুলিতে সেই কাজ হলেও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী ব-দ্বীপ ভূতনিতে হয়নি ৷"
মঙ্গলবার সকালে গঙ্গার জলস্তর ছিল 25.06 মিটার ৷ সর্বোচ্চ বিপদসীমা 25.30 মিটার থেকে কিছুটা নীচে থাকলেও বিপদসীমা 24.69 মিটার থেকে উপরে ৷ তবু এ দিন আশার কথা শুনিয়েছেন দু'দিন আগেই দায়িত্ব নেওয়া জেলা সেচ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার শিবনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ৷ এ দিন ফোনে তিনি ইটিভি ভারতকে জানান, "আমাদের কাছে কিছু স্পেশাল টেকনিক রয়েছে ৷ গতকাল আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসেছিলেন ৷ তাঁদের নির্দেশমতো এবার থেকে আমরা সেই টেকনিক ব্যবহার করার চেষ্টা করব ৷ আজ বিকেল থেকেই সেই কাজ শুরু করার চেষ্টা করছি ৷ এতে হয়তো জল পুরোপুরি আটকানো যাবে না ৷ কিন্তু কিছুটা হলেও কাজ হবে ৷"