ETV Bharat / state

সাক্ষাৎ যেন 'দশভুজা' ! অকালে বাবাকে হারিয়ে ব্যবসার হাল ধরেছেন এমএ পড়ুয়া মৌমিতা - BUSINESSWOMAN

ক্যানসারে হারিয়েছেন বাবাকে ৷ কচুরি বেলা থেকে গ্রাহকদের পরিবেশেন, দু'হাতে সব সামলাচ্ছেন হাবরার মৌমিতা ওঝা ৷ সঙ্গে চলছে এমএ-এর পড়াশোনাও ৷

Businesswoman
বাবাকে হারিয়ে সংসারের ভার সামলাচ্ছেন তরুণী (নিজস্ব ছবি)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Oct 7, 2024, 8:04 PM IST

হাবড়া, 7 অক্টোবর: সাক্ষাৎ যেন 'দশভুজা' ! দেবী 'দুর্গা'র মতো হয়তো তাঁর হাতে 'অস্ত্র' নেই ৷ কিন্তু, একা হাতে দিব্যি সামলে যাচ্ছেন দশদিক । কখনও ময়দার লেচি গোল করছেন তো, কখনও আবার সেই লেচি দিয়ে কচুরি বানিয়ে তা পরিবেশন করে চলেছেন একের পর এক গ্রাহকের কাছে । চোখে-মুখে ক্লান্তি থাকলেও অস্বস্তি নেই এতটুকু ৷ তিনি হাবড়ার 26 বছরের এমএ পড়ুয়া মৌমিতা ওঝা ।

মৌমিতা নামের থেকে লোকে অবশ্য তাঁকে বেশি চেনে 'মৌ' নামেই । কারণ, ওই নামেই তাঁর একটি কচুরির দোকান রয়েছে হাবড়া স্টেশনে । দোকানের সামনে বড় বড় করে ঝুলছে সেই সাইন বোর্ডও । তাতেই লেখা, 'মৌ'-এর কচুরি । দু'দিন বাদেই দেবী 'দশপ্রহরণধারিণী'র বোধন ৷ ষষ্ঠীর বোধনের আগে মা দুর্গার আরধনায় চলছে পাড়ার মণ্ডপে, মণ্ডপে প্রস্তুতি । তবে পরিবারের কাছে জীবন্ত 'দশভুজা' হয়ে উঠেছেন হাবড়ার তরুণী মৌমিতা ওঝা ওরফে মৌ । মারণ রোগ ক্যানসার প্রাণ কেড়েছে বাবার ৷ এরপর থেকেই মৌ নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ।

মৌমিতার কচুরির দোকান রয়েছে হাবড়া স্টেশনে (ইটিভি ভারত)

তবে, সংসার সামলাতে বাবার কচুরির দোকানের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেও পড়াশোনা কিন্তু ছেড়ে দেননি তরুণী । বিধাননগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ইতিমধ্যেই পাস করেছেন তিনি । বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ করছেন মৌমিতা । অসময়ে বাবার ফেলা যাওয়া কচুরির দোকানই এখন দিশা দেখাচ্ছে হাবড়ার তরুণীকে ।

হাবড়া স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মের ওভারব্রিজের নিচে মৌ'দের এই কচুরির ব্যবসা দীর্ঘদিনের । একসময়ে তাঁর বাবা বিষ্ণু ওঝা এবং জেঠু, এই দু'জনে মিলেই কচুরি বিক্রি করতেন । লকডাউনের সময় সেই ব্যবসা আলাদা হয় । তখন মৌ ইতিহাস অনার্সের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া । তার পরই বিষ্ণুবাবুর লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে । সেই সময় বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য দোকানে আসতে শুরু করেন মৌমিতা ।

Businesswoman
কচুরির দোকানের সব কাজে সিদ্ধহস্ত তিনি (নিজস্ব ছবি)

তাঁর কথায়, "অসুস্থ বাবাকে সাহায্য করতেই দোকানে আসা শুরু করি । ভেবেছিলাম বাবা একটু সুস্থ হলে পড়াশোনায় মন দেব । অসুস্থ অবস্থায় বাবাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে দোকানে এসে পরিশ্রম করতেন । কখনও কখনও তো পরিশ্রমের ঠেলায় কাশতে কাশতে মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসত । সন্তান হিসাবে বাবার এই কষ্ট দেখে কী করে বাড়িতে বসে থাকতাম !"

Businesswoman
এখন কর্মচারীদের নিয়ে নিজেই সামলান দোকান (নিজস্ব ছবি)

যদিও, শেষ রক্ষা হয়নি । মারণব্যাধি ক্যানসার 2021 সালে প্রাণ কেড়ে নেয় মৌমিতার বাবার । তিনি মারা যাওয়ার পর সংসারে অনটন দেখা দেয় মৌ'দের ৷ তাই সংসারের হাল ধরতে বাবার ব্যবসাতেই মনোনিবেশ করেন কলেজ ছাত্রী । তবে পড়াশোনা ছেড়ে দেননি মৌমিতা । তরুণী বলেন, "হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আমাদের । মা আর আমার বাঁচার জন্য দোকান চালানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না । তাই নিজেই ব্যবসার হাল ধরি ।"

তবে, 'বটবৃক্ষের' চলে যাওয়ায় সূর্যের প্রখর তেজ প্রতি পদে অনুভব করেন । একসময় বেচাকেনাও প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় । কিন্তু জীবনযুদ্ধে হার মানেননি তিনি । দাঁতে, দাঁত কামড়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করেছেন । তার ফলও মেলে । স্টেশনের পুরনো দোকানের পাশাপাশি যশোর রোড সংলগ্ন হাবড়ার দাসপাড়ায় আরেকটি দোকান হয়েছে । দু’টি দোকান মিলিয়ে আটজন কাজ করেন 'মৌ'-এর অধীনে । এখন নিজের পরিবারের পাশাপাশি আরও আটজনের পরিবারের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে ।

Businesswoman
বাবার কাছ থেকেই তাঁর ব্যবসায় হাতে খড়ি (নিজস্ব ছবি)

এ দিকে, উচ্চশিক্ষিত হয়েও পারিবারিক এই ব‍্যবসাকেই আগামিদিনে তিনি পেশা করতে চান বলে জানিয়েছেন মৌমিতা । তাঁর মতে, "এখন এই দোকানে মোট সাতজন কর্মচারী রয়েছেন আমাকে সহযোগিতা করার জন্য । নতুন দোকানে আরও একজন রয়েছেন । সকলেরই সংসার চলছে এই দুটি দোকানের উপর নির্ভর করে । আমি মনে করি যদি মন থেকে কারোর কিছু করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সকলের পক্ষেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব । কোনও কাজই ছোট নয় । এটা মনে রাখা উচিত সকলের ।"

Businesswoman
দোকান সামলে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি (নিজস্ব ছবি)

অন‍্যদিকে, মৌমিতার এই লড়াই সংগ্রামকে কুর্নিশ জানাতে ভোলেননি এলাকার লোকজন । জয়দীপ বিশ্বাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, "মৌ'দের মতো মেয়েরা পশ্চিমবঙ্গের গর্ব । এটা আজ থেকে নয় ! আদি কাল থেকেই দেখা গিয়েছে অভাব অনটন থাকা সত্ত্বেও বাড়ির মেয়েরা সংসারের হাল ধরার পর লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছে । বর্তমান সময়ে বাংলার কর্মসংস্কৃতির অবস্থা যা তাতে মৌ'দের মতো মেয়েদের সংসারের হাল ধরতেই হবে ৷ এঁরাই তো দেবী দুর্গার নামান্তর ৷ ওঁর জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল । জীবনে আরও বড় হোক । সমাজের হাল ধরুক, সেটাই চাই ।"

Businesswoman
এমএ পড়ুয়া মৌমিতা ওঝা (নিজস্ব ছবি)

হাবড়া, 7 অক্টোবর: সাক্ষাৎ যেন 'দশভুজা' ! দেবী 'দুর্গা'র মতো হয়তো তাঁর হাতে 'অস্ত্র' নেই ৷ কিন্তু, একা হাতে দিব্যি সামলে যাচ্ছেন দশদিক । কখনও ময়দার লেচি গোল করছেন তো, কখনও আবার সেই লেচি দিয়ে কচুরি বানিয়ে তা পরিবেশন করে চলেছেন একের পর এক গ্রাহকের কাছে । চোখে-মুখে ক্লান্তি থাকলেও অস্বস্তি নেই এতটুকু ৷ তিনি হাবড়ার 26 বছরের এমএ পড়ুয়া মৌমিতা ওঝা ।

মৌমিতা নামের থেকে লোকে অবশ্য তাঁকে বেশি চেনে 'মৌ' নামেই । কারণ, ওই নামেই তাঁর একটি কচুরির দোকান রয়েছে হাবড়া স্টেশনে । দোকানের সামনে বড় বড় করে ঝুলছে সেই সাইন বোর্ডও । তাতেই লেখা, 'মৌ'-এর কচুরি । দু'দিন বাদেই দেবী 'দশপ্রহরণধারিণী'র বোধন ৷ ষষ্ঠীর বোধনের আগে মা দুর্গার আরধনায় চলছে পাড়ার মণ্ডপে, মণ্ডপে প্রস্তুতি । তবে পরিবারের কাছে জীবন্ত 'দশভুজা' হয়ে উঠেছেন হাবড়ার তরুণী মৌমিতা ওঝা ওরফে মৌ । মারণ রোগ ক্যানসার প্রাণ কেড়েছে বাবার ৷ এরপর থেকেই মৌ নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ।

মৌমিতার কচুরির দোকান রয়েছে হাবড়া স্টেশনে (ইটিভি ভারত)

তবে, সংসার সামলাতে বাবার কচুরির দোকানের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেও পড়াশোনা কিন্তু ছেড়ে দেননি তরুণী । বিধাননগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ইতিমধ্যেই পাস করেছেন তিনি । বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ করছেন মৌমিতা । অসময়ে বাবার ফেলা যাওয়া কচুরির দোকানই এখন দিশা দেখাচ্ছে হাবড়ার তরুণীকে ।

হাবড়া স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মের ওভারব্রিজের নিচে মৌ'দের এই কচুরির ব্যবসা দীর্ঘদিনের । একসময়ে তাঁর বাবা বিষ্ণু ওঝা এবং জেঠু, এই দু'জনে মিলেই কচুরি বিক্রি করতেন । লকডাউনের সময় সেই ব্যবসা আলাদা হয় । তখন মৌ ইতিহাস অনার্সের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া । তার পরই বিষ্ণুবাবুর লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে । সেই সময় বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য দোকানে আসতে শুরু করেন মৌমিতা ।

Businesswoman
কচুরির দোকানের সব কাজে সিদ্ধহস্ত তিনি (নিজস্ব ছবি)

তাঁর কথায়, "অসুস্থ বাবাকে সাহায্য করতেই দোকানে আসা শুরু করি । ভেবেছিলাম বাবা একটু সুস্থ হলে পড়াশোনায় মন দেব । অসুস্থ অবস্থায় বাবাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে দোকানে এসে পরিশ্রম করতেন । কখনও কখনও তো পরিশ্রমের ঠেলায় কাশতে কাশতে মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসত । সন্তান হিসাবে বাবার এই কষ্ট দেখে কী করে বাড়িতে বসে থাকতাম !"

Businesswoman
এখন কর্মচারীদের নিয়ে নিজেই সামলান দোকান (নিজস্ব ছবি)

যদিও, শেষ রক্ষা হয়নি । মারণব্যাধি ক্যানসার 2021 সালে প্রাণ কেড়ে নেয় মৌমিতার বাবার । তিনি মারা যাওয়ার পর সংসারে অনটন দেখা দেয় মৌ'দের ৷ তাই সংসারের হাল ধরতে বাবার ব্যবসাতেই মনোনিবেশ করেন কলেজ ছাত্রী । তবে পড়াশোনা ছেড়ে দেননি মৌমিতা । তরুণী বলেন, "হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আমাদের । মা আর আমার বাঁচার জন্য দোকান চালানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না । তাই নিজেই ব্যবসার হাল ধরি ।"

তবে, 'বটবৃক্ষের' চলে যাওয়ায় সূর্যের প্রখর তেজ প্রতি পদে অনুভব করেন । একসময় বেচাকেনাও প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় । কিন্তু জীবনযুদ্ধে হার মানেননি তিনি । দাঁতে, দাঁত কামড়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করেছেন । তার ফলও মেলে । স্টেশনের পুরনো দোকানের পাশাপাশি যশোর রোড সংলগ্ন হাবড়ার দাসপাড়ায় আরেকটি দোকান হয়েছে । দু’টি দোকান মিলিয়ে আটজন কাজ করেন 'মৌ'-এর অধীনে । এখন নিজের পরিবারের পাশাপাশি আরও আটজনের পরিবারের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে ।

Businesswoman
বাবার কাছ থেকেই তাঁর ব্যবসায় হাতে খড়ি (নিজস্ব ছবি)

এ দিকে, উচ্চশিক্ষিত হয়েও পারিবারিক এই ব‍্যবসাকেই আগামিদিনে তিনি পেশা করতে চান বলে জানিয়েছেন মৌমিতা । তাঁর মতে, "এখন এই দোকানে মোট সাতজন কর্মচারী রয়েছেন আমাকে সহযোগিতা করার জন্য । নতুন দোকানে আরও একজন রয়েছেন । সকলেরই সংসার চলছে এই দুটি দোকানের উপর নির্ভর করে । আমি মনে করি যদি মন থেকে কারোর কিছু করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সকলের পক্ষেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব । কোনও কাজই ছোট নয় । এটা মনে রাখা উচিত সকলের ।"

Businesswoman
দোকান সামলে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি (নিজস্ব ছবি)

অন‍্যদিকে, মৌমিতার এই লড়াই সংগ্রামকে কুর্নিশ জানাতে ভোলেননি এলাকার লোকজন । জয়দীপ বিশ্বাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, "মৌ'দের মতো মেয়েরা পশ্চিমবঙ্গের গর্ব । এটা আজ থেকে নয় ! আদি কাল থেকেই দেখা গিয়েছে অভাব অনটন থাকা সত্ত্বেও বাড়ির মেয়েরা সংসারের হাল ধরার পর লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছে । বর্তমান সময়ে বাংলার কর্মসংস্কৃতির অবস্থা যা তাতে মৌ'দের মতো মেয়েদের সংসারের হাল ধরতেই হবে ৷ এঁরাই তো দেবী দুর্গার নামান্তর ৷ ওঁর জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল । জীবনে আরও বড় হোক । সমাজের হাল ধরুক, সেটাই চাই ।"

Businesswoman
এমএ পড়ুয়া মৌমিতা ওঝা (নিজস্ব ছবি)
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.